সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রম দারিদ্র্যবিমোচনে কতটা সহায়ক
গত ৬ জুন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী জাতীয় সংসদে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রস্তাবিত জাতীয় বাজেট উপস্থাপন করেছেন। ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকার এ বাজেট দেশের এ যাবৎকালের সর্ববৃহৎ বাজেট। চলতি (২০২৩-২৪) অর্থবছরের মূল বাজেটের আকার ছিল ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা, যা সংশোধিত বাজেটে হ্রাস পেয়ে দাঁড়িয়েছে ৭ লাখ ১৪ হাজার ৪১৮ কোটি টাকায় (অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তৃতা ২০২৪-২৫)। চলতি অর্থবছরের সংশোধিত জাতীয় বাজেট বরাদ্দের তুলনায় আগামী অর্থবছরের প্রস্তাবিত জাতীয় বাজেটে বরাদ্দ ৮২ হাজার ৫৮২ টাকা বাড়লেও দারিদ্র্য হ্রাসের অন্যতম পন্থা হিসাবে স্বীকৃত সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রমের উপকারভোগীর সংখ্যা বৃদ্ধির তুলনায় বরাদ্দ বাড়েনি। এ অবস্থায় সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রমের মাধ্যমে ‘দারিদ্র্যবিমোচন ত্বরান্বিত করার’ সরকারি লক্ষ্য কতটা বাস্তবায়িত হবে, তা আলোচনা করাই এ নিবন্ধের উদ্দেশ্য।
২০০৫ সালে পরিকল্পনা কমিশন প্রণীত ‘Poverty Reduction Strategy Paper’ (PRSP) বা দারিদ্র্যবিমোচন কৌশলপত্রে (পিআরএসপি) সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রমকে সংজ্ঞায়িত করতে গিয়ে বলা হয়েছে, ‘Social Safety-Nets is defined as actions, policies and programmes that attempt to reduce poverty through direct transfer of resources to the poor’, যার অর্থ দাঁড়ায়-সামাজিক সুরক্ষা বলতে বোঝায় দারিদ্র্য হ্রাসে গরিবদের কাছে সরাসরি সম্পদ হস্তান্তরে গৃহীত কার্যাবলী, নীতি ও কর্মসূচি। পিআরএসপিতে আরও বলা হয়েছে, ‘In Bangladesh, expansion of targeted income, employment and food aided safety net programmes under the government initiatives have been found to be effective in providing the safety nets’, অর্থাৎ সরকারি উদ্যোগে বাংলাদেশে নির্দিষ্ট আয়বর্ধক, কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং খাদ্য সাহায্যপুষ্ট কার্যক্রমের বিস্তৃতিতে সামাজিক নিরাপত্তামূলক কর্মসূচি অধিকতর কার্যকর হয়ে ওঠে।
দেশে সামাজিক সুরক্ষা কর্মকাণ্ডের আওতায় যারা সরাসরি উপকারভোগী, তাদের মধ্যে রয়েছেন-গরিব/অতি গরিব ব্যক্তি, গরিব/অতি গরিব, বিধবা/স্বামী নিগৃহীতা মহিলা, অসচ্ছল প্রতিবন্ধী, প্রতিবন্ধী ছাত্রছাত্রী, গ্রামীণ এলাকায় দরিদ্র গর্ভবতী মা, শহর অঞ্চলে কম আয়ের কর্মজীবী ল্যাকটেটিং মাদার, এতিম শিশু, বীর মুক্তিযোদ্ধা, হিজড়া, বেদে ও অনগ্রসর জনগোষ্ঠী, চা-শ্রমিক, ক্যানসার-কিডনি-লিভার সিরোসিস-স্ট্রোকে প্যারালাইজড ও জন্মগত হৃদরোগী।
উপর্যুক্ত বিভিন্ন শ্রেণির উপকারভোগীদের মধ্যে বয়স্ক ভাতাভোগীর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। গত কয়েক বছর ধরে এদের সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। যেমন-২০১৮-১৯ অর্থবছরে এ কর্মসূচির আওতাভুক্ত গরিব/অতি গরিব বয়স্ক ব্যক্তির সংখ্যা ছিল ৪০ লাখ, যা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেয়ে চলতি অর্থবছরে (২০২৩-২৪) দাঁড়ায় ৫৮ লাখ ১ হাজারে। আগামী অর্থবছরের প্রস্তাবিত জাতীয় বাজেটে এ সংখ্যা ৬০ লাখ ১ হাজারে উন্নীত করার প্রস্তাব করা হয়েছে। অর্থাৎ আগামী অর্থবছরে এ শ্রেণিতে ২ লাখ ভাতাভোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে। চলতি অর্থবছরে এ শ্রেণির ভাতাভোগীদের মাসিক ভাতার হার ৬০০ টাকা, যা আগামী অর্থবছরে অপরিবর্তিত থাকবে।
পরের অবস্থানে রয়েছে বিধবা ও স্বামী নিগৃহীতা নারী। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির আওতায় এ শ্রেণির ভাতাভোগীর সংখ্যা ছিল ১৪ লাখ, যা ক্রমান্বয়ে বেড়ে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ২৫ লাখ ৭৫ হাজারে দাঁড়ায়। আগামী অর্থবছরের প্রস্তাবিত জাতীয় বাজেটে এদের সংখ্যা বেড়ে হবে ২৭ লাখ ৭৫ হাজার। বৃদ্ধির সংখ্যা ২ লাখ। এই শ্রেণির ভাতাভোগীদের বিদ্যমান মাসিক ভাতার হার ৫৫০ টাকা, যা আগামী অর্থবছরে অপরিবর্তিত থাকবে।
গ্রামীণ এলাকার দরিদ্র গর্ভবতী মায়েদের জন্য বিদ্যমান মাতৃত্বকালীন ভাতা এবং শহরাঞ্চলের কম আয়ের কর্মজীবী মায়েদের জন্য ল্যাকটেটিং ভাতা-এ কর্মসূচি দুটিকে সমন্বিত করে সরকার ‘মা ও শিশু সহায়তা কর্মসূচি’ নামে বাস্তবায়ন শুরু করেছে। ২০২১-২২ অর্থবছরে এ কর্মসূচির অধীনে উপকারভোগীর সংখ্যা ছিল ১০ লাখ ৪৫। ২০২২-২৩ অর্থবছরে উপকারভোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ১২ লাখ ৫৪ হাজারে, যা ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ১৫ লাখ ৪ হাজার ৮০০-তে উন্নীত হয়। আগামী অর্থবছরের প্রস্তাবিত জাতীয় বাজেটে এই শ্রেণির ভাতাভোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে ১৬ লাখ ৫৫ হাজার ২৮০-তে দাঁড়াবে। ভাতাভোগী বাড়বে ১ লাখ ৫০ হাজার ৪৮০ জন।
২০২১-২০২২ অর্থবছরে প্রতিবন্ধী ভাতাপ্রাপ্তের সংখ্যা ছিল ২০ লাখ ৮ হাজার, যা বৃদ্ধি পেয়ে ২০২২-২৩ অর্থবছরে ২৩ লাখ ৬৫ হাজারে দাঁড়ায়। আগামী অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে এ সংখ্যা দাঁড়াবে ৩২ লাখ ৩৪ হাজারে, যা চলতি অর্থবছরের ২৯ লাখের তুলনায় ৩ লাখ ৩৪ হাজার বেশি। তাছাড়া আগামী অর্থবছরের বাজেটে প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্য উচ্চমাধ্যমিক স্তরের উপবৃত্তির হার বিদ্যমান ৯৫০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১০৫০ টাকা করার প্রস্তাব করা হয়েছে।