আওয়ামী লীগের ৭৫ বছর: জনগণের দল থেকে ‘বুদবুদে’ বসবাস
আওয়ামী মুসলিম লীগ হিসেবে যাত্রা শুরু করা আওয়ামী লীগের ৭৫ বছরের ইতিহাসকে সংক্ষেপে বর্ণনা করতে গেলে বলতে হবে, দলটির এই যাত্রায় তিনটি ধাপ রয়েছে—প্রতিষ্ঠাকালীন আওয়ামী লীগ, বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ এবং শেখ হাসিনা হাল ধরার পরের আওয়ামী লীগ।
১৯৪৯ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে ১৯৭১ সালে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় পর্যন্ত আওয়ামী লীগ ছিল দেশের সব ধরনের গণতান্ত্রিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের রচয়িতা ও মূল চালিকাশক্তি। দলটি পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের সব ধরনের অধিকার আদায়ের দাবিকে বলিষ্ঠ রূপ দিতে নিরলস কাজ করে গেছে। পাকিস্তান আমলে রাজনৈতিক দল হিসেবে একমাত্র আওয়ামী লীগই ছিল আমাদের সব গণতান্ত্রিক আশা-আকাঙ্ক্ষার ধারক ও বাহক।
প্রথম পর্যায়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দুটি ঘটনা ঘটে, যা আওয়ামী মুসলিম লীগকে সবার নজরে আনে। প্রথমটি ছিল ভাষা আন্দোলন, যা পূর্ব পাকিস্তানের মানুষকে একাত্ম করে। এর মাধ্যমে আওয়ামী মুসলিম লীগ বাংলাদেশের প্রকৃত কণ্ঠস্বর হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। দ্বিতীয়টি ছিল যুক্তফ্রন্টের ব্যানারে নির্বাচনে অংশগ্রহণ, যেখানে আওয়ামী মুসলিম লীগ সবচেয়ে বড় ও সক্রিয় অংশীদার হিসেবে ১৪৩ আসনে জয় পায়। মোট ৩০৯টি আসনের মধ্যে যুক্তফ্রন্ট ২২৮টি আসনে জয়লাভ করে। এসব ঘটনার মাধ্যমে আওয়ামী মুসলিম লীগ রাজনৈতিক দল হিসেবে শক্ত অবস্থান তৈরি করে।
১৯৫৪ সালের নির্বাচন প্রমাণ করেছে যে আওয়ামী মুসলিম লীগের জন্ম অনেক বড় একটি ঘটনা—যার গুরুত্ব তখনো মানুষ পুরোপুরি অনুধাবন করতে পারেনি, এখনো পারছে না। বিষয়টির গভীরতা নিয়ে যথাযথ গবেষণা হয়নি এবং এর গুরুত্ব পরবর্তীতে গবেষণা বা প্রকাশিত বইয়ে পুরোপুরি উঠে আসেনি। এটা ছিল পাকিস্তানের আদর্শের প্রতি মোহভঙ্গের সূচনা; একটি নবগঠিত রাষ্ট্রের একমাত্র ভিত্তি ধর্ম হতে পারে কি না, সেটা নিয়ে প্রশ্ন তোলার শুরু। আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রমাণ করে যে জনগণ পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা দল মুসলিম লীগের ওপর থেকে ভরসা হারিয়েছে। পরবর্তীতে সামরিক বাহিনীর সমর্থন ছাড়া মুসলিম লীগ আর ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি।
নতুন দলটি যারা গঠন করেছিলেন, তাদের প্রায় সবাই পাকিস্তান আন্দোলনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ছিলেন এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও মাওলানা ভাসানীর মতো কয়েকজন ছিলেন সম্মুখসারির নেতা। তাহলে কেন সাফল্যের সঙ্গে পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠনের পরও এই নেতারা এবং তাদের হাজারো অনুসারী মুসলিম লীগ থেকে সরে গেলেন?
উত্তর খুবই সহজ। পাকিস্তানের জন্মের পর মুসলিম লীগ হঠাৎ করেই নিজেদেরকে পশ্চিম পাকিস্তানের সামন্ত ও জমিদার বংশীয় ধনাঢ্যদের, বিশেষত পাঞ্জাবের বাসিন্দাদের স্বার্থ রক্ষায় নিয়োজিত একটি দল হিসেবে উপস্থাপন করতে শুরু করে। দেশের বৈচিত্র্যময় ভাষাগত ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য রক্ষায় তথাকথিত পাকিস্তানি নেতৃত্ব একেবারেই চিন্তা করেনি। নতুন দেশটির সবচেয়ে বড় জনগোষ্ঠী হয়েও বাঙালিরা দেখতে পেলো, তাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, বিশেষত তাদের মায়ের ভাষা বাংলাকে রাষ্ট্র ভাষার মর্যাদা থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে।
- ট্যাগ:
- মতামত
- প্লাটিনাম জুবিলি
- আওয়ামী লীগ