অবক্ষয় ও পুলিশ
পুলিশ বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তা চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন বলেছেন, ‘কারো বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেয়া হবে। পুলিশ দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতিতে অটল।’ পুলিশের কর্তাব্যক্তিরা এমন কথা প্রায়ই বলেন। সাবেক পুলিশ প্রধান বেনজীর আহমেদও বলতেন। অথচ তার বিরুদ্ধেই ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। প্রতিদিন গণমাধ্যমের খবরে সাবেক এই পুলিশ কর্তার নতুন নতুন অবৈধ সম্পত্তির খবর মিলছে।
পুলিশের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ নতুন নয়। কিন্তু বেনজীর আহমেদের দুর্নীতির বিষয়টি সামনে চলে আসার পর আরও বেশ কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তার দুর্নীতি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে। পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের (এসবি) অতিরিক্ত ডিআইজি রফিকুল ইসলামের বিরুদ্ধে অনুসন্ধানে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশন। পুলিশের এই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নামে-বেনামে শত কোটি টাকার সম্পদ অর্জনের অভিযোগ রয়েছে। গত ২০ মে মেহেদী হাসান নামে এক পুলিশ কনস্টেবলের বিরুদ্ধে দুদকের রাজশাহী কার্যালয়ে মামলা হয়েছে। অতিরিক্ত পুলিশ সুপার উত্তম কুমার বিশ্বাসকে দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে আদালত। সাবেক ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়ার বিরুদ্ধেও দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে।
পুলিশের দুর্নীতি নিয়ে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হওয়ায় বাংলাদেশ পুলিশ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে প্রতিবাদ জানিয়ে বিবৃতি দেওয়া হয়েছে। দুর্নীতি নয়, গণমাধ্যমে পুলিশ কর্মকর্তাদের দুর্নীতির খবর প্রকাশকেই কার্যত অ্যাসোসিয়েশন সমালোচনা করেছে। এই নিয়ে গণমাধ্যম কর্মীদের সঙ্গে অ্যাসোসিয়েশনের নেতাদের মধ্যে বাদানুবাদ চলছে।
বাংলাদেশ পুলিশ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের নেতারা যাই বলুক, নিজেদের যত ধোয়া তুলসি পাতাই মনে করুক, আমাদের দেশের মানুষের সাধারণ ধারণা হলো পুলিশ মানেই দুর্নীতি। প্রতিষ্ঠানটির কনস্টেবল থেকে শুরু করে আইজি পর্যন্ত দুর্নীতির একটি চেইন কাজ করে।
অভিজ্ঞরা বলেন, নতুন যারা পুলিশের চাকরিতে আসে তারা এই দুর্নীতির চেইনের মধ্যে ঢুকে যায় এবং আর কখনোই বের হতে পারে না। অনেকেই এ ব্যাপারে ওসির মোটরসাইকেল কেনাকে উদাহরণ হিসেবে টানেন। প্রতি থানায় ওসিদেরকে মোটরসাইকেল কিনতে দেখা যায়। এই মোটরসাইকেল তারা কেনেন চাকরি পাওয়ার পর নিজের ঋণ করা টাকায় এবং ওই টাকা তোলার জন্য তারা শুরু করেন চাকরি জীবনের প্রথম দুর্নীতি। চাকরি পেতে ঘুষ তো আছেই। পুলিশ মানেই টাকার খেলা। টাকা ঢালতে না পারলে নিয়োগ যেমন হয় না, ভালো জায়গায় পোস্টিংও হয় না। ‘ভালো জায়গা’ মানে ঘুষ খাওয়ার ভালো সুযোগ। সব থানায়, সব এলাকায় এই সুযোগ থাকে না। ‘ভালো জায়গায়’ পোস্টিং পেতে হলে ঊর্ধ্বতনদের বিপুল পরিমাণ ঘুষ দিতে হয়। যাদের এই সামর্থ্য থাকে না, তাদের বছরের পর বছর একই জায়গায় গুরুত্বহীন পদে কাটাতে হয়।
পুলিশের ঘুষের ক্ষেত্রেগুলো কী? গ্রেফতার, ট্রাফিক-সংক্রান্ত বিষয়, পাসপোর্টের পুলিশ ভেরিফিকেশন, মামলা দায়ের, চার্জশিট, কোনো কোনো ক্ষেত্রে জিডি করা। সবেচেয়ে বেশি দুর্নীতি হয় চার্জশিট-সংক্রান্ত বিষয়ে। হাইওয়ে পুলিশ, স্পেশাল ব্রাঞ্চ, থানা পুলিশ-সবারই কমবেশি দুর্নীতির অভিজ্ঞতা আছে। বড় কর্তারা আরও নানা ধরনের দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েন। এর মধ্যে রেশন আছে, কেনাকাটা আছে। বিভিন্ন ধনাঢ্য ব্যক্তির কাছ থেকে পাওয়া ‘উপহার-উপঢৌকন’ আছে।
আশঙ্কার কথা হচ্ছে, পুলিশের মধ্যে দুর্নীতির ব্যাপ্তি ও গভীরতা ক্রমেই বাড়ছে। চাঁদাবাজি, ছিনতাই, গ্রেফতার বা ভয় দেখিয়ে টাকা আদায় করার পাশাপাশি ডাকাতি, মাদক কেনাবেচা, ধর্ষণের মতো অপরাধমূলক ঘটনা দিন দিন বাড়ছে। তবে কি পুলিশে সৎ ও ভালো মানুষের সংখ্যা দিন দিন কমছে?
সেটাও বলা যাবে না। পুলিশের ঊর্ধ্বতন পদে যারা কাজ করেন, ঘুষ-দুর্নীতির সুযোগ তাদের বেশি। কিন্তু এই লেভেলে খুবই কমসংখ্যক লোক কাজ করে। পুলিশে কর্মরত প্রায় এক লাখ ৪৫ হাজার সদস্যের মধ্যে শতকরা তিরানব্বই ভাগ কনস্টেবল, নয়তো শিক্ষানবিশ কনস্টেবল। অধীনস্তদের নিয়ন্ত্রণ, মামলা রুজু, মামলা তদন্ত, তদন্ত তদারকি, আসামি গ্রেফতার, খানা তল্লাশি ইত্যাদি কাজের সঙ্গে সরাসরি জড়িত পুলিশ সদস্যের সংখ্যা তাদের মোট সংখ্যার অতি সামান্য। পুলিশ লাইন্সে কর্মরত নায়েক, হাবিলদার, সুবেদারদের ঘুষের সুযোগ আরও কম। রিজার্ভ ফোর্স বা আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নে কর্মরত পুলিশ অফিসারদের অপারেশনাল কার্যক্রম নেই। তাদের অবৈধ আয়ের সুযোগও তেমন নেই। থানায় কর্মরত সেন্ট্রি, ডিউটি করা গোবেচারা কনস্টেবলটি কতটা দুর্নীতি করতে পারে?
পুলিশের শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা থেকে নিম্নস্তর পর্যন্ত অনেক সৎ ও আদর্শবান ব্যক্তি আছেন যারা দুর্নীতি করেন না। তারা বিভাগে অনুসরণীয় চরিত্রের অধিকারী। অথচ ঘুষ-দুর্নীতির অপবাদ দেয়ার ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষ কাউকেই বাদ দেন না। সৎ পুলিশের জন্য এটা একটা বড় সমস্যা। অল্প কিছু দুর্নীতিবাজ পুলিশের দায় পুরো বাহিনীর ওপর পড়ে।
- ট্যাগ:
- মতামত
- দুর্নীতি
- পুলিশ কর্মকর্তা
- বেনজীর আহমেদ