ক্যাপাসিটি চার্জে ক্যাপাসিটি হারানো
বছরে চারবার বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধি করে তিন বছরে মোট ১২ দফায় এর দাম বাড়ানো হবে। তিন বছর পর সরকার বিদ্যুৎ খাতে আর ভর্তুকি দেবে না। এমন সিদ্ধান্তের কথা আইএমএফের প্রতিনিধি দলকে জানিয়েছে সরকার। আইএমএফের কাছ থেকে সরকার ৪৭০ কোটি ডলার ঋণ সহায়তা নিচ্ছে। সেই ঋণের তৃতীয় কিস্তির ৭০ কোটি ডলার ছাড় করতে প্রতিনিধি দলটি তাদের দেওয়া শর্তের অগ্রগতি দেখতে ঢাকায় এসেছিল গত এপ্রিলে।
সরাসরি দরপত্রের বাইরে গিয়ে বিভিন্ন কোম্পানিকে দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র নির্মাণ করেছে সরকার। গত বছর এমন বিদ্যুৎকেন্দ্রের ৪১ শতাংশ খামোখা বসে ছিল। এসব কোম্পানির সঙ্গে সরকারের চুক্তিতে শর্ত ছিল– বিদ্যুৎ না কিনলেও তাদের টাকা দেবে, যাকে বলা হচ্ছে ক্যাপাসিটি চার্জ। গত বছর এ চার্জ বাবদ সরকারি ব্যয় ছিল ২৬ হাজার কোটি টাকা। এর সঙ্গে আছে প্রায় ১১ শতাংশ সিস্টেম লস। ১ শতাংশ সিস্টেম লসের জন্য জনগণকে গুনতে হয় ৭০০ কোটি টাকা। অঙ্কের হিসাবে মোট ৭ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। অর্থাৎ প্রায় ৩৪ হাজার কোটি টাকা সরকার বিনা কারণে খরচ করে।
এখন এ ব্যয় তুলতে বিদ্যুতের দাম বাড়বে। বিগত বছরে ৩ হাজার ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুতের লোডশেডিং হয়েছে। গ্রামাঞ্চলে দিনে ৮-১০ ঘণ্টাও বিদ্যুৎ থাকেনি। বছরে চারবার বিদ্যুতের দাম বাড়লে পাইকারি দামে বিদ্যুৎ কিনতেই খরচ পড়বে প্রতি ইউনিট ১৫ টাকা। এর সঙ্গে সিস্টেম লস, ডিমান্ড চার্জ, পিএফআই চার্জ, ভ্যাট যুক্ত হয়ে খুচরা বা ভোক্তা পর্যায়ে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম দ্বিগুণের বেশি হয়ে যাবে।
এ কথা সত্য, ১৫ বছর আগে সাময়িক সমাধান হিসেবে বেসরকারি কুইক রেন্টাল সার্ভিসের যৌক্তিকতা আছে। তার মানে এই নয়, এ পদ্ধতিই বিদ্যুৎ সমস্যার একমাত্র সমাধান। এ জন্য সরকার ১৫ বছর আগে স্বল্পমেয়াদি একটি আইন করে নিতে পারত। তা না করে বছরের পর বছর বিনা বিদ্যুতে উচ্চ ভাড়ায় বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের পেছনে এমন খরচের যৌক্তিকতা কী? কেনইবা জনগণের টাকা লুটপাটের এমন বৈধতা বা দায়মুক্তি দেওয়া?
বিদ্যুৎ খাতের অনিয়ম, অপচয়, দুর্নীতির সুন্দর সুন্দর ইংরেজি নাম দেওয়া হয়। জেনারেল এরশাদের আমলে এটি শুরু। সে সময় আমরা ‘সিস্টেম লস’ শব্দের সঙ্গে পরিচিত হই। বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে গ্রাহকের কাছে পৌঁছানো পর্যন্ত যে লাইন থাকে, তাতে যে পরিমাণ বিদ্যুৎ খরচ হয়, তার দাম গ্রাহককে দিতে হয়। এ পদ্ধতিতে শুরু হয় বিদ্যুৎ চুরি। এরশাদের আমলে মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনের ৪০ শতাংশ সিস্টেম লসের আওতায় চুরি হওয়ার নজির স্থাপিত হয়েছিল। এখন দেখছি ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ ২৬ হাজার কোটি টাকার অপচয়।
এদিকে ক্যাপাসিটি চার্জের খরচ মেটাতে দেশের জনগণ জীবনযাপনে ক্যাপাসিটি হারাচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, বিদ্যুতের কল্পিত চাহিদা দেখিয়ে লুটপাটের উদ্দেশ্যেই এ ধরনের বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনে সরকারকে ভুল পথে নিয়ে গেছেন কিছু বিশেষজ্ঞ, সরকারি কর্মকর্তা ও লুটপাটকারী। অবিলম্বে অক্ষম বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো বন্ধ না করলে বাংলাদেশ হয়তো নিঃস্ব হয়ে যাবে।
বাংলাদেশে এই শতাব্দীর শুরুতে ‘তেল- গ্যাস-খনিজসম্পদ বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি’ নামে একটি নাগরিক সংগঠন গ্যাস রপ্তানির বিরুদ্ধে জনমত গঠন করে আন্দোলনের সূচনা করেছিল। মূলত বামপন্থি দলগুলো সমর্থিত এই জাতীয় কমিটিও ক্যাপাসিটি চার্জের বিরুদ্ধে বড় কোনো প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারেনি।
আমাদের আশা, জনগণের টাকার এমন লুটপাট বন্ধে সরকারকে বাধ্য করতে দেশের ভেতর শক্তিশালী জনমত গড়ে উঠবে। স্থিতিশীলতা ফিরে আসবে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে।