‘তুমি যে সুরের আগুন লাগিয়ে দিলে মোর প্রাণে’

যুগান্তর ড. হাসনান আহমেদ প্রকাশিত: ০৬ জুন ২০২৪, ১১:২৯

নিন্দুকেরা প্রায়ই আমাকে একহাত দেখিয়ে ছাড়েন। বলেন, আমি সুযোগ পেলেই নাকি রাজনীতিকদের বিরুদ্ধে দু’কলম ঠুকে বসি। কথাটা অমূলক নয়। এছাড়া যে আমার আর কোনো গত্যন্তর নেই, তা বোঝাব কেমনে। কেন জানি সুদীর্ঘ বছর পেরিয়ে বেলাশেষে এসে এ ধারণা আমার মাথায় ঢুকেছে যে, একটা দেশের উন্নতি ও অবনতির মূলে থাকেন রাজনীতিকরা। এখানে যদি দুর্নীতিবাজ, ভাঁওতাবাজ, ফন্দিবাজ ব্যবসায়ী, ফেরেববাজ এসে আস্তানা গাড়ে, তাহলে দেশটার বিচ্ছিরি-বিতিকিচ্ছি দশা হওয়া অবশ্যম্ভাবী নয় কি? এ রাজনীতিকদের কারণেই দেশটা রসাতলে যেতে বসেছে। কারণ তারাই তো একজোট হয়ে দেশ পরিচালনা করেন। সে বিবেচনায় এদেশের সব অনিষ্টের মূল এই বিকৃত রাজনীতি, রাজনীতির নামে দেশ শোষণ-লুটপাট, তা সে যে দলেরই হোক না কেন। সেই স্বাধীনতার পর থেকে কখনো দলগতভাবে, আবার কখনো জোটবদ্ধভাবে অধিকাংশ দলই ক্ষমতায় থেকেছে। তাদের কর্মকাণ্ড আমরা দেখেছি, এখনো দেখছি। দেখতে দেখতে আমাদের বদ্ধমূল ধারণা জন্মেছে, ‘বিকৃত রাজনীতি’ ও মতলববাজি এদেশের মূল রোগ। এই চাঁচাছোলা কথা যাদের বিরুদ্ধেই যাক না কেন, এ রোগের চিকিৎসা না হওয়া পর্যন্ত দেশ গড়ে তোলা অসম্ভব।


আসলে রাজনীতি একটা বিমূর্ত ধারণা। এটা আবার খারাপ হয় কী করে? খারাপের দায়টা এসে রাজনীতিকদের ওপরেই পড়ে। রাজনীতিকরা চিন্তাধারায় উন্নত হলেই দেশের উন্নতি হতে বাধ্য। রাজনীতিকদের চরিত্র (প্রকৃতি, স্বভাব) খারাপ, তাদের উদ্দেশ্য খারাপ, তাই রাজনীতি খারাপ। মাঝখান থেকে ভুগতে হচ্ছে দেশকে, দেশের সাধারণ মানুষকে। আমার মতো এক-পা কবরে থাকা মানুষের তো আশায় আশায় জীবনটা পার হয়ে গেলে। এখন বেলাশেষের ভাবনা ভাবতে গিয়ে হতাশা ছাড়া আর কিছু অবশিষ্ট নেই। ভাষাও অনেক কর্কশ হয়ে গেছে। এর সঙ্গে হিউম্যান সাইকোলজি জড়িত। এ নিয়ে অনেকেই আমার সঙ্গে তর্কে জড়িয়ে পড়েন। আমাকে হতাশাবাদী বলেন। কিন্তু আমি আর কতদিন আশায় আশায় দিন পার করব? তাদের আমি মনে মনে দলকানা বা বিবেকহীন বলি, যদিও কথাটা সামনে বলি না। মানুষের মনুষ্যত্ব ও কর্মকে বিবেচনা না করে অন্ধ দলীয়-সমর্থক হওয়া কোনো রাজনীতিসচেতন শিক্ষিত লোকের শোভা পায় না। এমনটি হলে তাকে শিক্ষিতও বলা যায় না। যে সাদাকে সাদা ও কালোকে কালো বলতে জানে না, তাকে শিক্ষিতইবা বলি কী করে? কেউ বলেন, অমুক দল খারাপ, তাই দেশের উন্নতি হচ্ছে না, অন্য দল ক্ষমতায় এলে ঠিকই ভালো কিছু হতো। এ ধরনের কথায় আস্থা রাখতে পারি না, বিশ্বাসও করি না। আমি দেখি সব দলের রাজনীতির মাথা থেকে পা পর্যন্ত পচে গেছে, সেখান থেকে দুর্গন্ধ বেরোচ্ছে। যে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, আইন প্রয়োগের দ্বৈত-মান ও জিঘাংসার আগুন রাজনীতিকরা এদেশের মানুষের মনে জ্বেলে দিয়েছেন ও এখনো দিচ্ছেন, এর পরিণতি আমরা সবাই বুঝতে পারছি। এ পচনের রেশ সমাজের পরতে পরতে ছড়িয়ে গেছে। সাধারণ মানুষকে পর্যন্ত আক্রান্ত করে ছেড়েছে। রবিঠাকুরের কথায়, ‘তুমি যে সুরের আগুন লাগিয়ে দিলে মোর প্রাণে, সে আগুন ছড়িয়ে গেল, সে আগুন ছড়িয়ে গেল সবখানে।’ তা দেশ ভালো চলবে কী করে? একটা ভালো আলুকে পচানো সম্ভব; পচা আলুকে পূর্বাবস্থায় আনা কি সম্ভব? আলুটাকে মাটিচাপা দিতেই হবে। নইলে গন্ধ ছড়াবে। এর কোনো বিকল্প নেই। পচা আলুর যে কী দুর্গন্ধ, কখনো ঘ্রাণ নিয়ে দেখেছেন কি? যতই আতর-থেরাপি প্রয়োগ করুন, গন্ধ দূর হবে না। আমি প্রকৃতির নিয়ম থেকে কথাগুলো বলছি। এই পচা রাজনীতি আমার মতো কোটি কোটি মানুষের নিষ্কলুষ জীবনের ভবিষ্যৎ, লালিত স্বপ্ন ধ্বংস করে দিয়েছে, তাই আমি এসব কথা বলতে বাধ্য। শ্রেণিকক্ষে ছাত্রছাত্রীদের অনেক কথার উত্তর দিতে পারি না। মাথাটা হেঁট হয়ে যায়। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে (আমার ছাত্রছাত্রীদের) কোন নরকে রেখে মরতে চলেছি, সে কথা ভাবলে গা শিউরে ওঠে। আমার এসব ক্ষোভের কথা ছাপাতে সংশ্লিষ্ট সম্পাদকের অনেক ভাবতে হয় জানি। কিন্তু এসব কথা না লিখতে পারলে আমি যে অসহায় হয়ে উঠি, রাতের পর রাত নির্ঘুম কাটাতে হয়। আমরা কি দলবাজি করব, না উচিত কথা বলব? এর বিকল্প আমি আর তো কিছু খুঁজে পাই না।


রাজনৈতিক দল গঠন করতে পারতাম। তা সম্ভব নয়। যা দেখছি, সুবিধা না দিতে পারলে ত্যাগের মহিমায় উদ্দীপ্ত হয়ে দেশ গড়ার কাজে এদেশে কেউ আমার রাজনৈতিক দলে যোগ দেবে বলে মনে হয় না। এ কথা ভাবলে বড় বড় নেতারা সাগরেদদের সুবিধা দিতে বাধ্য হচ্ছেন কেন, তা বুঝে আসে। মূলত জনগোষ্ঠী জনসম্পদ না হয়ে জন-আপদে পরিণত হয়ে গেছে। আমরাই তাদের জন-আপদ বানিয়েছি। এ কথা অনেকবার যুক্তি দিয়ে এ কলামে লিখেছিও। এ কথা বুঝতে পেরেই হয়তো কেউ নতুন দল গঠন ঘোষণা করার পরও মনোভাব প্রত্যাহার করে নিয়েছে। হাঁড়ি চাটতে না দিলে দলে লোক পাওয়া দুষ্কর। দেশাত্মবোধে উজ্জীবিত, নৈতিকতাবোধ-সম্পন্ন জনমানুষের সংখ্যা এদেশে অতিঅল্প। তারা কোটরের প্যাঁচার মতো অতিসন্তর্পণে দিনযাপন করছেন; বিড়ালের মতো নিঃশব্দে পা ফেলে চলছেন। দুর্নীতিবাজ ও ক্ষমতাধরদের সীমাহীন দাপটে তারা দেশের উন্নয়নে কোনো ভূমিকা রাখতে পারছেন না। এর মধ্যে আবার উদয়াস্ত গতর খেটে জীবনযাপন করে, কারও সাতে-পাঁচে থাকতে চায় না, এমন নিরীহ জনগোষ্ঠী রাজনীতিতে আসবে এমনটিও ভাবা উচিত নয়। এদের ‘অন্নচিন্তা চমৎকার’। তাদের সবসময় গণনা থেকে বাদ রাখি। এরা নিজে ভোগে, অন্যকে ভোগায় না। একমাত্র সুশিক্ষা এদেশকে রক্ষা করতে পারে। শিক্ষার মানেরও শীর্ণদশা, ক্ষীয়মান; তা নিয়েও রাজনীতি ও ব্যবসা। এ নিয়েও দেশি-বিদেশি চক্রান্ত। মাথা ন্যাড়া হলে মাথা চাটা সহজ হয়।


বর্তমানে কয়েকটা সংবাদ ‘টক অব দ্য কান্ট্রি’ বলা যায়। এর মধ্যে দুই-তিনটাকে প্রাসঙ্গিক হিসাবে টেনে আনি। আগেই এমপি আনার, ‘যার জনসমর্থন দেখে সরকার তিনবার এমপি মনোনয়ন দিয়েছে’, সে কথায় আসি। তার হত্যা নিঃসন্দেহে মর্মন্তুদ, বীভৎস ও করুণ। পাষাণ হৃদয়ও এমন ঘটনা শুনলে ব্যথিত হয়। বিভিন্ন পত্রিকা ও সামাজিক মিডিয়া তাকে নিয়ে অনেক রকম কথা লিখে চলেছে। অনেক পত্রিকায় স্বর্ণ চোরাচালানি, মাদক চোরাকারবারি, নারী পাচারকারী, কালোবাজারি, রাতচরা-বাহিনীর গডফাদার ইত্যাদি বিভিন্ন কাজের সঙ্গে তিনি সম্পৃক্ত ছিলেন বলে খবর বেরোচ্ছে। তার নামে এর আগে অনেক খারাপ মামলাও নাকি ছিল। এমনভাবে কথা বলা হচ্ছে যে, না বিশ্বাস করে পারা যাচ্ছে না। যদিও চলতি সমাজব্যবস্থায় নিজের কান ও চোখ ছাড়া কোনো কিছুকে বিশ্বাস করা কঠিন। এখানে বিশ্বাস-অবিশ্বাসের প্রশ্ন নয়। প্রশ্ন হলো, তিনি এত খারাপ লোকই যদি হবেন, কেন তিনি পরপর তিনবার এমপি নির্বাচিত হলেন? কারা তাকে মনোনয়ন দিল? তিনি জাতীয় পর্যায়ের নেতা ছিলেন না জানি। এর আগে কোনোদিন তার নামও শুনিনি। মনোনয়ন দেওয়ার আগে কি সরকারের কোনো বিশ্বস্ত বিভাগের মাধ্যমে খবরও নেওয়া হয়নি? সেখানকার রিপোর্ট কী বলে? একজন মরার পরই সব তথ্য প্রকাশ পায়, আগে তথ্য আসে না কেন? এলেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয় না কেন? নাকি রাজনৈতিক দলগুলো বিভিন্ন অঞ্চলের দাগি আসামিদেরই বেছে বেছে মনোনয়ন দেয়? নাকি পেশিশক্তিধারী দাগি আসামি ছাড়া রাজনীতিতে ইদানীং ভালো কোনো লোক নাম লেখাতে চাচ্ছেন না? নাকি দাগি লোক ছাড়া বর্তমান রাজনীতিতে সুবিধা করা যায় না? এসব কথা আমি শুধু ক্ষমতাসীন দলকেই বলছি না।

সম্পূর্ণ আর্টিকেলটি পড়ুন

প্রতিদিন ৩৫০০+ সংবাদ পড়ুন প্রিয়-তে

আরও