পানির সংকটে কেবল দাম নিয়ে আলোচনা!
গত ১ জুলাই থেকে ঢাকা ওয়াসার পানির জন্য ১০ শতাংশ বেশি দাম দিতে হবে এর গ্রাহকদের। নতুন অর্থবছরের সঙ্গে অবশ্য এর সম্পর্ক তেমন নেই। জুন থেকেও এ বর্ধিত দাম কার্যকর হতে পারত। বিদ্যুতের ক্ষেত্রে কিন্তু এমনও হয়েছে, পূর্ববর্তী মাস থেকে কার্যকর হয়েছে বর্ধিত দাম। সরকার দাম বাড়ানোর ভঙ্গিতে থাকলে এসব ঘটতেই পারে। বিদ্যুৎ বা পানির মতো ‘সরকারি পণ্যের’ দাম বাড়াতে গিয়ে সংশ্লিষ্টরা অনেক সময় বিধিরও পরোয়া করেন না। যেমন, এর আগে ঢাকা ওয়াসা পানির দাম বাড়াতে চেয়েছিল ‘বিধি প্রণয়ন’ না করে। প্রশ্নটি হাইকোর্টে তোলা হলে রুল জারি হয় এবং তাতে দাম বাড়ানোর উদ্যোগ আটকে যায়। এরপর কীভাবে কী হলো-নতুন করে পানির দাম বাড়ানো হচ্ছে ১০ শতাংশ।
এভাবে দাম বাড়ানোর ‘বৈধতা’ নিয়ে তো বটেই, প্রশ্ন উঠেছে এর যৌক্তিকতা নিয়েও। আমি বৈধতা নয়; যৌক্তিকতার মধ্যে থাকব। ওয়াসা বলছে, মূল্যস্ফীতি সমন্বয়ের স্বার্থে এ দাম বৃদ্ধি। এদিক থেকে বক্তব্যটা ঠিকই আছে। মূল্যস্ফীতি তো দীর্ঘদিন ধরেই ৯-এর উপরে; ১০ ছুঁইছুঁই। তাছাড়া ওয়াসা অনেকদিন ধরে বলছে, পানির দামে তার উৎপাদন ব্যয়টুকুও উঠছে না। সংস্থাটির এমডি মনে করিয়ে দিচ্ছেন, সরকারের কাছ থেকে টাকা-পয়সা এনে পানি জোগাতে আর পারবেন না। তাকে অন্তত ‘না লাভ না লোকসানে’ থাকতে হবে। আলাদা করে তাকে দোষ দেওয়া যাবে না। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রীও বলে দিয়েছেন, ধাপে ধাপে সরকার এসব ক্ষেত্রের ভর্তুকি থেকে বেরিয়ে আসতে চায়। এরই মধ্যে মাসে মাসে জ্বালানির ‘মূল্য সমন্বয়ের’ ব্যবস্থা হয়েছে। সে অনুযায়ী চলতি মাসে এর দাম বেড়েছে নতুন করে। বিশ্ববাজারে জ্বালানির দাম কিছুটা কমলেও টাকার অবমূল্যায়নে দেশে এর দাম বাড়ল। জ্বালানির দামে উচ্চ কর-শুল্কও আরোপিত রয়েছে। সেটা কমানো হলে এক্ষেত্রে কিছুটা ‘নিম্নমুখী সমন্বয়’ হয়তো করা যেত। কিন্তু সরকার এটা করছে না। এ খাতে বরং কিছু বাড়তি আয়ের সুযোগ রাখছে।
সরকার বিদেশি মুদ্রার বিনিময় হারটাও ছেড়ে দিতে চাইছে বাজারের ওপর। সে লক্ষ্যে চালু করেছে ‘ক্রলিং পেগ’। এতে করে ডলারের আনুষ্ঠানিক দামও গেছে অনেকখানি বেড়ে। কার্ব মার্কেটে দাম স্বভাবতই আরও বেশি। আমদানিসহ অর্থনীতিতে এর প্রভাব পড়তেও শুরু করেছে। এখন ওয়াসাও জোর দিয়ে বলতে পারবে, পানি পরিশোধনের উপকরণসহ দরকারি জিনিসপত্র আমদানিতে তাদের ব্যয় বেশি পড়ে যাচ্ছে ডলারের দামের কারণে। সুতরাং পানির দাম আরও বাড়াতে হবে! বছরে ৫ শতাংশ করে দাম বাড়ানোর অধিকার নাকি তাকে দেওয়াই আছে। এর বেশি হারে বাড়াতে হলে নিতে হয় সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সম্মতি। পানির দামটা স্পর্শকাতর বলেই বুঝি নিতে হয় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের ‘এনওসি’ও। ওয়াসা মাঝে অবশ্য চেয়েছিল বিভিন্ন শ্রেণির গ্রাহকের সামাজিক অবস্থান অনুয়ায়ী পানির দাম বাড়াতে। সেটা করা গেলে অবশ্য কোনো কোনো ক্ষেত্রে আরও অনেক বেশি হারে দাম বাড়ানো যেত। এ বিষয়ে ওয়াসা কিছু ‘টেকনিক্যাল স্টাডি’ও করেছিল।
যা হোক, শেষতক যে সিদ্ধান্ত হয়েছে, সেটা নিয়েই দুটো কথা এখানে বলি। প্রথমত, এটা আচমকা সিদ্ধান্ত নয়। ওয়াসা তো পানির দাম বাড়িয়েই চলেছে। ঢাকায় ১৬ বছরে ১৬ বার পানির দাম বাড়ল-রয়েছে এমন সংবাদ শিরোনাম। কোনো কোনো বছরে দু’বারও দাম বাড়ানো হয়েছে। সেটা অবশ্য ঘটিয়েছে চট্টগ্রাম ওয়াসা। সে নগরীতে পানি সরবরাহ পরিস্থিতি ঢাকার চেয়ে খারাপ। ওখানে পানির দামও ঢাকার চেয়ে বেশি। এর ওপর তারা সম্প্রতি দাম বাড়াতে চাইছেন ৩০ শতাংশ! মন্ত্রণালয় দামের এতটা বৃদ্ধি অনুমোদন করবে বলে মনে হয় না। ঢাকা ওয়াসা জানাচ্ছে, তারা আরও বেশি হারে দাম বাড়াতে চাইলেও সম্মতি মেলেনি। এর পরের ধাপে পানির বিভিন্ন দাম নির্ধারণে তারা মন্ত্রণালয়কে রাজি করাতে পারবেন বলে অবশ্য আশাবাদী। সত্যি বলতে, স্থানীয় সরকার মন্ত্রীই এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন-ধনী আর গরিব ভোক্তা কেন একই হারে বিল পরিশোধ করবেন? সরকারি পণ্য বা সেবার দাম একেক আয়গোষ্ঠীর কাছ থেকে একেক হারে নেওয়ার রীতি তো আছে। এতে রাজস্ব বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে কিছুটা হলেও ন্যায় প্রতিষ্ঠা সম্ভব বলে অনেকের ধারণা।
পানির দাম বাড়াতে গিয়ে ঢাকা ওয়াসা যেভাবে তার ব্যয় ও আয়ের হিসাব দিচ্ছে, তা নিয়ে অবশ্য প্রশ্ন আছে। চট্টগ্রাম ওয়াসাও দেখাচ্ছে, বছরের পর বছর পানি বিক্রি করে ‘লাভে’ আছে তারা। তখন এ প্রশ্নটা স্বভাবতই ওঠে, তাহলে কেন এ উচ্চ মূল্যস্ফীতির মধ্যে আবার পানির মতো জরুরি পণ্যের দাম বাড়ানো? এর জবাবে তখন বলা হয়, বিদেশি ঋণে বিভিন্ন প্রকল্পের বাস্তবায়ন চলাকালে সেটা পরিশোধের সময় এসে যাচ্ছে! আরও দুটি চালু ওয়াসা কর্তৃপক্ষ রয়েছে দেশে-রাজশাহী ও খুলনা ওয়াসা। সিলেটেও ওয়াসা গঠিত হয়েছে, যদিও পানি সরবরাহের কাজটা সেখানে এখনো করছে সিটি করপোরেশন। এ পাঁচ নগরীতেই পানি নিয়ে মানুষের অভিজ্ঞতা মোটামুটি অভিন্ন। খবরগুলোও বলতে গেলে এক প্রকৃতির। কোনো ওয়াসাই পানিসহ বিধিবদ্ধ সেবা জুগিয়ে গ্রাহকদের সন্তুষ্ট করতে পারছে না। বিশেষত পানির মান কোনোখানেই গ্রহণযোগ্য নয়। এ অবস্থায় যেসব উন্নয়ন প্রকল্প গৃহীত হচ্ছে, তাতে বিপুল ব্যয় হলেও প্রত্যাশিত সুফল মিলছে না। এর মাশুল আবার গুনতে হচ্ছে ওয়াসার সেবা গ্রহীতাদের। সে কারণেই প্রায় প্রতিবছর পানির দাম বাড়িয়ে এমনকি প্রকল্প ব্যয় নির্বাহের একটা প্রবণতা দেখা যাচ্ছে সবখানে। ঢাকা ওয়াসা নাকি ১৯ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে-যেগুলোর গতি ধীর আর সুফল দৃশ্যমান নয়। চট্টগ্রামেও ঘটনা প্রায় অভিন্ন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিপুল ব্যয়ে ‘ক্যাপাসিটি’ বাড়ানো হলেও পয়ঃনিষ্কাশন থেকে নিয়ে পরিশোধিত পানি সরবরাহে এর সদ্ব্যবহার পরিলক্ষিত হচ্ছে না। অবস্থা অনেকটা বিদ্যুৎ খাতের মতো। সেখানেও কিন্তু গ্রাহককে বেশি দাম দিতে হচ্ছে, এমনকি অব্যবহৃত ‘ক্যাপাসিটি চার্জের’ কারণে উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাওয়ায়।