শতভাগ পেনশন সমর্পণ নিয়ে জটিলতা
অবসরে যাওয়া সরকারি কর্মচারীরা তাদের সর্বশেষ আহরিত বেতনের একটি নির্দিষ্ট অংশের সমপরিমাণ অর্থ পেনশন পেয়ে থাকেন। এ ব্যবস্থা শতাব্দী প্রাচীন। পেনশনের এ অংকের অর্ধেক সমর্পণ করে তারা প্রতি টাকার বিনিময়ে ২০০ টাকা করে এককালীন অর্থ পেতেন (এ হার পরে বাড়ানো হয়েছে) এবং বাকি অর্ধেক মাসিক পেনশন হিসেবে পেতে থাকতেন। এর সঙ্গে যোগ হতো চিকিৎসা ভাতা আর বছরে দুবার উৎসব ভাতা। ১৯৯৪ সালে সরকার সিদ্ধান্ত নেয় যে কর্মচারীরা চাইলে তাদের পুরো পেনশনই সমর্পণ করতে পারবেন, তবে দ্বিতীয়ার্ধের জন্য প্রতি টাকায় পাবেন ১০০ টাকা (এ হারও পরে পরিবর্তন হয়েছে)। ২০১৭ সালের ১ জুলাই থেকে এ নিয়ম রহিত করে পেনশন ব্যবস্থা আগের নিয়মে ফিরে গেছে।
২০১৮ সালে অজ্ঞাত কারণে সরকার সিদ্ধান্ত নেয় যে পুরো পেনশন সমর্পণের পর যাদের ১৫ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে তারা আবার নিয়মিত পেনশন পাবেন। অর্থাৎ পেনশনের যে দ্বিতীয় অর্ধেকও তারা নগদায়ন করেছেন, তারা আবার সেই পরিমাণ পেনশন পাবেন। ১৯৯৪ থেকে ২০১৭—এ ২৩ বছরে যারা পুরো পেনশন সমর্পণ করেছেন, তারা এ সুবিধার আওতায় আসেন। স্বাভাবিকভাবেই সরকারের বদান্যতায় এ অপ্রত্যাশিত সুবিধা পেয়ে তারা পুলকিত হয়েছেন। আর যারা আগের নিয়মে অর্ধেক পেনশন সমর্পণ করে বাকি অর্ধেক মাসিক ভিত্তিতে নিচ্ছিলেন, তারা হিসাব করতে বসলেন কতটা লোকসান হলো তাদের সিদ্ধান্তে।
হিসাবটা এ রকম। ২০০৯-এর নতুন স্কেলে সর্বোচ্চ বেতন ছিল ৪০ হাজার টাকা। এ পর্যায় থেকে যিনি অবসরে গেলেন তার পেনশন নির্ধারিত হলো ৮০ শতাংশ হারে ৩২ হাজার টাকা। অর্ধেক সমর্পণ করে তিনি মাসিক ১৬ হাজার টাকা পেনশন পেতে থাকলেন। তার যে সহকর্মী পুরো পেনশন সমর্পণ করলেন, তিনি ১৬ হাজার টাকা মাসিক পেনশনের বিনিময়ে পেলেন অতিরিক্ত ১৬ লাখ টাকা, যা তিনি পেনশনার সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করলেন এবং সুদ বাবদ পেতে থাকলেন মাসে ১৬ হাজার টাকা (প্রথমে এ হার আরেকটু বেশি ছিল, সম্প্রতি আবার বেশ একটু কম, আমি গড় হিসাব ধরছি)। অর্থাৎ দুজনেরই মাসিক প্রাপ্তি সমান, কিন্তু দ্বিতীয়জনের সম্পদ ১৬ লাখ টাকা অটুট রয়ে গেল। ১৫ বছর সমাপ্তিতে ২০২৪ সালে দ্বিতীয়জন আবার সমর্পিত ১৬ হাজার টাকা পেনশন হিসেবে পাচ্ছেন। অর্থাৎ সরকার থেকে সরাসরি প্রাপ্তি দুজনেরই সমান হয়ে গেছে। দ্বিতীয়জনের সঞ্চয়পত্রে যে ১৬ লাখ টাকা বিনিয়োগ রয়ে গেছে এবং তা থেকে তিনি যে সুদ পাচ্ছেন তার পুরোটাই প্রথম পেনশনারের তুলনায় তার নিট লাভ।
বয়োজ্যেষ্ঠ পেনশনারদের কিছু অতিরিক্ত সুবিধা যদি সরকার দেয়, এমনকি যদি তা সবার প্রতি সমান ন্যায্য নাও হয়, তাতেও তেমন ক্ষতি নেই। দেশের সবই যে ন্যায্যতার ভিত্তিতে চলছে, এমন তো নয়। ২৯ মে বণিক বার্তায় একজন পেনশনার ১৫ বছরের বিধানকে ১০ বছরে নামিয়ে আনার এবং সাত বছর থেকেই আংশিক সুবিধা দেয়ার প্রস্তাব করেছেন। এটা কতটা যথাযথ হবে তা হয়তো সরকার বিবেচনা করে দেখবে। তবে তার প্রস্তাব অনুযায়ী, পেনশনার সঞ্চয়পত্রে সুদ না কমালে সব পেনশনার এ দুর্মূল্যের বাজারে খানিকটা রিলিফ পেতে পারতেন। সাধারণভাবে যেহেতু ব্যাংকে সুদ বেড়েছে, এক্ষেত্রে প্রযোজ্য সুদহার পূর্বাবস্থানে ফেরত নেয়া খুব অযৌক্তিক হবে না। এটা করতে পারলে এ সাত বছর, ১০ বছরের হিসাব না করলেও চলত।
পেনশন নিয়ে আরেকটি বিষয় জোরালো বিবেচনার দাবি রাখে। আমার মনে পড়ে, সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, যিনি একসময় সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ের আমলা ছিলেন, তিনি পেনশন পেতেন ৪ হাজার টাকার মতো। তার অধীনে যারা সহকারী সচিব ছিলেন, তারাও তখন অবসরে। তাদের পেনশন ছিল ১২ হাজার টাকা। পেনশনের উদ্দেশ্য তো হলো অবসরে যাওয়া কর্মচারী যেন এ অর্থে জীবন ধারণ করতে পারেন। দুজনের জন্যই তো বাজারে জিনিসপত্রের দাম একই। অধিক বয়স্ক মানুষটি কী করে তার সহকর্মীর তুলনায় এক-তৃতীয়াংশ (বা অর্ধেক) পেনশনে তার জীবন নির্বাহ করবেন? এ সমস্যার একমাত্র সমাধান প্রতিটি স্কেলের সঙ্গে একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ পেনশন যুক্ত করে দেয়া।
- ট্যাগ:
- মতামত
- পেনশনের টাকা
- সরকারি কর্মচারী