কৃষি খাতে বরাদ্দ বাড়ানো খুবই জরুরি
দেশের বিভিন্ন খাতে অধুনা যে অর্থনৈতিক অগ্রগতি হয়েছে, তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি দৃশ্যমান খাতটি হলো কৃষি। অতীতে বাংলাদেশ ছিল একটি খাদ্য ঘাটতির দেশ। এ অঞ্চলে প্রতিবছর গড়ে খাদ্য আমদানি করা হতো ১৫ থেকে ২০ লাখ টন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে এদেশে মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হয় কৃষির উৎপাদন। ফলে ১৯৭১-৭২ সালে দেশে খাদ্য ঘাটতির পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় ৩০ লাখ টন। এটি ছিল মোট উৎপাদনের প্রায় ত্রিশ শতাংশ। বর্তমানে সে ঘাটতির হার নেমে এসেছে ১৫ শতাংশেরও নিচে। স্বাধীনতার পর দেশে মোট খাদ্যশস্যের উৎপাদন ছিল ১ কোটি ১০ লাখ টন। এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪ কোটি ৬০ লাখ টনের উপরে। গত ৫৩ বছরে দেশে খাদ্যশস্যের উৎপাদন বেড়েছে প্রতিবছর গড়ে প্রায় ৩ শতাংশ হারে। যে কৃষক আগে খাদ্য ঘাটতিতে ছিল, এখন তার খাদ্য উদ্বৃত্ত। যে শ্রমিকের দাবি ছিল দৈনিক ৩ কেজি চালের সমান মজুরি, সে এখন কাজ করে ১০ কেজি চালের সমান দৈনিক মজুরিতে। কী কৃষক, কী শ্রমিক-কারোরই আর তেমন খাদ্যের অভাব হয় না। না খেয়ে দিন কাটে না কারোরই। কৃষি খাতে এখন উৎপাদন বেড়েছে বহুগুণ।
বর্তমানে চাল উৎপাদনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান তৃতীয়। বিভিন্ন ফসলের জাত উদ্ভাবন ও উন্নয়নে বাংলাদেশের স্থান হলো সবার উপরে। তাছাড়া পাট উৎপাদনে বাংলাদেশের স্থান দ্বিতীয়, সবজি উৎপাদনে তৃতীয়। চাষকৃত মৎস্য উৎপাদনে দ্বিতীয়, গম উৎপাদনে সপ্তম ও আলু উৎপাদনে অষ্টম বলে বিভিন্ন তথ্য থেকে জানা যায়। স্বাধীনতার পর থেকে এ নাগাদ চালের উৎপাদন বেড়েছে প্রায় চারগুণ, গম দুই গুণ, ভুট্টা ১০ গুণ ও সবজির উৎপাদন বেড়েছে পাঁচ গুণ। আলু, মৎস্য, মাংস ও ডিম উৎপাদনে বাংলাদেশ উদ্বৃত্ত। চিরকালের দুর্ভিক্ষ, মঙ্গা আর ক্ষুধার দেশে এখন ঈর্ষণীয় উন্নতি হয়েছে খাদ্য উৎপাদন ও সরবরাহের ক্ষেত্রে। প্রতিবছর এ দেশে মানুষ বাড়ছে ২০ লাখ। কৃষিজমি কমছে ৮ লাখ হেক্টর। তারপরও জনপ্রতি সরবরাহ কমছে না কৃষিপণ্যের। বরং তা বাড়ছে নিরন্তর। বিবিএস প্রদত্ত পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, শস্য কৃষি খাতের উৎপাদন বৃদ্ধির ধারা গত ৫৩ বছর ধরে জনসংখ্যার বৃদ্ধির হার থেকে গড়ে অনেকটা বেশি ছিল। গত ৩ বছরও তার কোনো ব্যতিক্রম ছিল না। ২০২০-২১ সালে প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৩.১৭ শতাংশ, ২০২১-২২ সালে ছিল ৩.০৫ শতাংশ এবং ২০২২-২৩ সালে ছিল ২.৬১ শতাংশ। তবে কোনো কোনো সময় তার চেয়ে অনেক বেশিও অর্জিত হয়েছে। যেমন ২০০৬-০৭ সালে ছিল ৭ শতাংশ এবং ২০০৯-১০ সালে ছিল ৭.৫৭ শতাংশ। আবার কোনো কোনো সময় ছিল কম। যেমন ২০১৫-১৬ এবং ২০১৬-১৭ সালে প্রবৃদ্ধির হার ছিল যথাক্রমে ০.৮৮ এবং ০.৯৬ শতাংশ। তবে দীর্ঘমেয়াদে গড়ে তা সন্তোষজনক। কিন্তু ধান উৎপাদনের প্রবৃদ্ধিতে সম্প্রতি অনেকটা ভাটা পড়েছে। চালের ২০১৯-২০ সালে মোট উৎপাদন ছিল ৩৮৬.৯৫ লাখ টন। এর পরের বছর অর্থাৎ ২০২০-২১ সালে ছিল ৩৭৬.০৮ লাখ টন। প্রবৃদ্ধির হার ছিল ঋণাত্মক ২.৮ শতাংশ। এরপর ২০২১-২২ সালে মোট উৎপাদন ছিল ৩৯১.৮ লাখ টন। প্রবৃদ্ধির হার ৪.৮ শতাংশ। ২০২২-২৩ সালে মোট উৎপাদন ছিল ৩৯০ লাখ টন। প্রবৃদ্ধির হার ঋণাত্মক, শূন্য দশমিক ৪৫ শতাংশ। অর্থাৎ গত ৩ বছরের গড় প্রবৃদ্ধির হার হলো ০.৫২ শতাংশ। এ সময় জনসংখ্যার গড় প্রবৃদ্ধির হার ছিল ১.৩৩ শতাংশ। ফলে চালের উৎপাদন বৃদ্ধির হার জনসংখ্যার প্রবৃদ্ধির হারকে ছাপিয়ে বড় ধরনের উদ্বৃত্ত সৃষ্টি করতে পারেনি। সে কারণে এবং খাদ্যশস্যের আন্তর্জাতিক মূল্যবৃদ্ধির চাপে অভ্যন্তরীণ বাজারে চালের দাম বেড়েছে। তাতে উপকরণের মূল্যবৃদ্ধিতে মূল্যস্ফীতি অনুঘটকের ভূমিকা পালন করেছে। এক্ষেত্রে ব্যবসায়ীদের কারসাজিও রয়েছে।
চালের উৎপাদন সম্পর্কে বিবিএস প্রদত্ত তথ্যের সঙ্গে কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ প্রদত্ত তথ্যের বড় ফারাক। কৃষি বিভাগের তথ্যে উৎপাদনের ঊর্ধ্বমুখী পক্ষপাত থাকা বিচিত্র নয়। এক্ষেত্রে বিবিএস প্রদত্ত তথ্যই বেশি গ্রহণযোগ্য। তারা তথ্য সংগ্রহের জন্য বিশেষভাবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও অভিজ্ঞ। কিন্তু তারা উৎপাদনের তথ্য বিশ্লেষণ ও তা প্রকাশে অনেক বিলম্ব করে থাকেন। যখন প্রকাশিত হয়, তখন তা প্রধানত লাইব্রেরি ও ব্যক্তিগত আলমারিতে শোভাবর্ধন করে মাত্র। অভ্যন্তরীণ উৎপাদন থেকে খাদ্যে সদয় স্বয়ম্ভরতার মাত্রা নির্ধারণ, আমদানি-রপ্তানির নীতিমালা প্রণয়ন এবং কর ও শুল্কারোপের হার নির্ধারণে তা খুব বেশি কাজে লাগে বলে মনে হয় না।