রাজনীতি কি লক্ষ্যভ্রষ্ট
আমি মূলত রাজনীতির মানুষ। গত শতকের ষাটের দশকে ছাত্র আন্দোলনের একজন কর্মী হিসেবে রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়ি। পাকিস্তানি সামরিক একনায়ক আইয়ুব-ইয়াহিয়ার বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতার যে লড়াই-সংগ্রাম, তার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবেই ছিলাম। ছিলাম গৌরবোজ্জ্বল মুক্তিযুদ্ধেও। দেশে বাম-প্রগতিশীল ধারার যে রাজনীতি তা খুব কাছে থেকেই দেখেছি। স্বাধীন বাংলাদেশের রাজনীতির উত্থান-পতনের আমি একজন প্রত্যক্ষদর্শী। একসময় যাঁরা ছিলেন দেশের রাজনীতির গতিপ্রকৃতির নিয়ন্ত্রক, তাঁদের প্রায় সবার সঙ্গেই আমার ব্যক্তিগত পরিচয় ছিল, একসঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতাও আছে। সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে রাজনীতির পথ নির্ধারণের প্রাথমিককালে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনকালে ভেতর-বাইরে কত ধরনের খেলা চলছিল, তার সবটা না হলেও অনেকটাই দেখা বা বোঝার সুযোগ আমার হয়েছে। বঙ্গবন্ধুকে ঘিরে কেমন রাজনীতি চলছিল, একদিকে দেশ পুনর্গঠনের কঠিন সংগ্রাম, বঙ্গবন্ধুর তিন বছর কিছু দিতে না-পারার আহ্বান, অন্যদিকে চাটার দলের উত্থান, চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা, মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর বৈরিতা, ভারত-সোভিয়েতের মনোভাব—সবই আমি দেখেছি। দেখেছি বঙ্গবন্ধু-হত্যা-পরবর্তী রাজনীতির পালাবদলও।
সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান কীভাবে সমন্বয়ের রাজনীতির নামে পাকিস্তানমুখী হয়ে মুক্তিযুদ্ধের ধারা থেকে দেশকে সরিয়ে নিয়েছেন, পরাজিত রাজাকার-আলবদরদের রাজনীতিতে পুনর্বাসিত হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছেন, রাজনীতিকে কেনাবেচার পণ্যে পরিণত করেছেন—এর সবই আমার দেখা। এক চরম প্রতিকূল পরিবেশে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা যে আওয়ামী লীগের হাল ধরলেন, তার পূর্বাপর ঘটনাধারার আমি একজন অংশীজন। আমি এখন সরাসরি রাজনীতির সঙ্গে সক্রিয় না হলেও রাজনীতিই আমার সারাক্ষণের ধ্যানজ্ঞান। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আমি একজন হিতার্থী। ব্যক্তিগতভাবে কিছু পাওয়ার প্রত্যাশা থেকে নয়, দেশ ও দেশের মানুষের ভালোর জন্যই আমি আওয়ামী লীগ সরকারের পক্ষে, শেখ হাসিনার পক্ষে। অনেকেই এটা জানেন, শেখ হাসিনার সঙ্গে আমার ভাই-বোন সম্পর্ক। তাঁকে আমি ‘গুড সিস্টার’ বলে সম্বোধন করি, তিনি আমাকে ‘ব্রাদার’ বলেন। এখন আমাদের খুব দেখা হয়, কথা হয়, তা নয়। কিন্তু তার মানে এটা নয় যে আমরা একে অপরের খোঁজখবর রাখি না।
শেখ হাসিনার সঙ্গে আমার এই প্রীতিময় সম্পর্কের কথা যাঁরা জানেন, তাঁরা আমার সঙ্গে এখন যোগাযোগ করেন কিছুটা উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার সঙ্গে। প্রায় সবাই জানতে চান, দেশে কী ঘটছে? শেখ হাসিনা ঠিক পথে আছেন তো? তিনি কি পারবেন ঘরে-বাইরে এত শত্রুর মুখে ছাই দিয়ে বাংলার দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর সংগ্রাম অব্যাহত রাখতে? এসব প্রশ্নের উত্তর সব আমার জানা, তা নয়। তবে কিছু কিছু ঘটনায় আমি পীড়িত বোধ করি, ব্যাখ্যা খুঁজে পাই না, আবার আস্থাও হারাই না। শেখ হাসিনা যখন আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্ব নেন, তখনো কারও কারও মনে সংশয় ছিল, তিনি পারবেন তো? তিনি প্রমাণ করেছেন, তিনি পারেন। আওয়ামী লীগ আর কোনো দিন ক্ষমতায় আসতে পারবে না বলে যারা আস্ফালন করত, তারা এখন ক্ষমতা থেকে দূরে, আর আওয়ামী লীগ টানা চার মেয়াদে সরকার গঠন করে নতুন ইতিহাস তৈরি করেছে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে।
প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ হাসিনা সফল হবেন কি না, সে প্রশ্নও তো ছিল। কী প্রমাণ হয়েছে? শেখ হাসিনার চেয়ে দক্ষ ও সফল শাসক শুধু বাংলাদেশে কেন, পৃথিবীতেই খুব বেশি নেই। আমি শেখ হাসিনার সাফল্যে গর্ব অনুভব করি। কিন্তু তার মানে কি এই যে দেশে যা ঘটছে, তার সবকিছু ঠিক? ভুল হচ্ছে না, অন্যায় কিছু হচ্ছে না? আমি অন্ধ নই, স্তাবক নই। তাই আমি মনে করি, দেশ এখন পুরোপুরি বঙ্গবন্ধুর আদর্শের ধারায় চলছে না। বঙ্গবন্ধুর নাম ব্যবহার করে কোথাও কোথাও এমন কিছু ঘটছে, যা বঙ্গবন্ধুর মুখ উজ্জ্বল না করে উল্টোটা করছে। তাই এখনই সতর্ক হতে হবে। শেখ হাসিনাকেও সবাইকে প্রশ্রয় দেওয়ার মনোভাব দূর করে কারও কারও প্রতি কঠোর হতে হবে। কিছু কিছু ঘটনা ঘটছে, যেগুলো সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত করছে। ব্যক্তিগতভাবে শেখ হাসিনার সততাকেও প্রশ্নবিদ্ধ করছে। যেহেতু সবাই মিলে এটাই বলা হয় যে শেখ হাসিনার নির্দেশ বা পরামর্শ ছাড়া কিছু হয় না, সেহেতু খারাপ কিছু হলে তার দায়ও স্বাভাবিকভাবেই শেখ হাসিনার ওপরও বর্তায়। ভালোটার জন্য প্রশংসিত হলে মন্দটার জন্য নিন্দিত কেন নয়?
- ট্যাগ:
- মতামত
- সাফল্য
- রাজনৈতিক নেতা
- শেখ হাসিনা