নৃশংস হত্যাকাণ্ডের মনস্তত্ত্ব
সাম্প্রতিক নৃশংস হত্যাকাণ্ডের বিবরণ জেনে যখন গা শিউরে ওঠে; কিংবা গাজা গণহত্যায় সব হারানো শিশুর আর্তচিৎকার মর্মে গিয়ে বিঁধে; তখন প্রশ্ন জাগে, মানুষ প্রজাতি আপন স্বার্থ চরিতার্থ করার সংকল্পেই কেবল মনোযোগী? একজন ব্যক্তি যেমনই হোক, আরেকজন কীভাবে তার দেহ ছিন্নবিচ্ছিন্ন করতে পারে? কোন ক্ষমতায় বলীয়ান হয়ে একটি গোষ্ঠী আরেকটি গোষ্ঠীকে নিশ্চিহ্ন করার সংকল্প নিতে পারে? এটা কি কেবল ব্যক্তি বা সমাজের অভিজ্ঞতালব্ধ, নাকি দেশ-জাতি-বর্ণ নির্বিশেষে মানুষের অন্তর্গত প্রতিফলন?
প্রশ্নগুলো আমাদের বিচলিত করবে; মানুষের ওপর বিশ্বাস হারাতে মন চাইবে– এটাই স্বাভাবিক। তবে আজকের এই অস্থির সময়ে এমন ঘটনা ঘটার পেছনের মনস্তাত্ত্বিক কারণগুলো খুঁজে দেখা যেতে পারে। একক কিংবা সামষ্টিক হননের পেছনে মনোবিকলনকে প্রধানত দায়ী করা হয়। নির্মম ঘটনার কথা জানলে প্রায়ই বলে উঠি, ‘এমন কাজটি একজন মানুষ কী করে করতে পারে!’
যে অপরাধী, তার মনের গঠনটি কেমন? সিগমুন্ড ফ্রয়েড মানবমনের গঠনকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনটি নির্দিষ্ট আঙ্গিক চিহ্নিত করেছেন– ইড, ইগো ও সুপার ইগো। ইড মানবমনের প্রথম আঙ্গিক, যা জন্ম থেকেই ব্যক্তিক চাহিদা তৈরি করে। ইগো বহির্জগতের সঙ্গে ইডের সংযোগ স্থাপন করে। অর্থাৎ ইগো হলো মানবমনের যুক্তিকেন্দ্র। আর সুপার ইগো হলো নীতিজ্ঞানের জায়গা, যা সমাজ প্রতিষ্ঠিত নিয়ম ও মানদণ্ডের পরিপ্রেক্ষিতে ব্যক্তির ক্রিয়াকর্মের নৈতিকতাকে বিচার করে থাকে। অপরাধী যখন সুপার ইগোকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে কেবল ইড চরিতার্থের নেশায় মত্ত হয়, তখন সমাজ নির্ধারিত ঠিক-বেঠিকের ধার ধারে না। আর ইগোকে সে কাজে লাগায় ইডের চাহিদা মেটানোর প্রয়াসে, যুক্তির খোলসে আবৃত করে। আর ইডকে ইন্ধন জোগায় অতীতে অনুভূত কোনো গভীর মনোকষ্ট বা ট্রমা, তীব্র কোনো অবচেতন বাসনা।
নির্মমতার সূত্রপাত ঘটে তখনই, যখন মানবমনের তিন নির্দিষ্ট আঙ্গিকের ভারসাম্যে ছেদ পড়ে। এমন ব্যক্তি ‘সাইকোপ্যাথ’ বলে চিহ্নিত। মার্কিন মনোবিজ্ঞানী হার্ভি ক্লেক্লি ১৯৪১ সালে ‘দ্য মাস্ক অব স্যানিটি’ গ্রন্থে সাইকোপ্যাথ চিহ্নিত করার ১৬টি নির্ণায়ক দাঁড় করান। এর মধ্যে রয়েছে অন্যের অমঙ্গল বা কষ্টে সহানুভূতির বোধ না থাকা, অনুতাপের অভাব, মিথ্যাচার, সমাজ-বিচ্ছিন্নতা, বুদ্ধিদীপ্ততা ও চটকদার বহিরাবয়ব। একজন সাইকোপ্যাথ তাই অনুতাপ ছাড়াই ভয়ানক অপরাধ সংঘটিত করতে পারে। ইডের তাড়না এতটাই তীব্র এবং সুপার ইগো এতটাই অপরিপক্ব, অনুশোচনার সুযোগই থাকে না।
এভাবে নিষ্ঠুরতার পেছনে যেমন ব্যক্তি নিজে দায়ী হতে পারে, অন্যদিকে সমাজ বা মতাদর্শের প্রভাবও হতে পারে প্রগাঢ়। পাশাপাশি সামষ্টিক মনস্তত্ত্বেরও নিবিড় যোগাযোগ থেকে যায়। তবে এটি সত্য, নির্মমতার বহিঃপ্রকাশ হত্যা দিয়ে ঘটুক বা গণহত্যায়, এর প্রতিরোধ বা প্রতিকার করতে গেলে ব্যক্তিক ও সামষ্টিক মনস্তত্ত্বকে বুঝতেই হবে।
- ট্যাগ:
- মতামত
- নৃশংস হত্যাকাণ্ড