সোনা, নারী আর ক্ষমতার মিশেলের ভয়টা যেখানে
ঘূর্ণিঝড় রিমালের তাণ্ডবে দেশ কেঁপেছে। তবে রাজনীতিতে কাঁপন ধরিয়ে দিয়েছে অন্য তিনটি ঘটনা। তিনটি ঘটনা তিনটি গল্প আসলে। একটি তো অবশ্যই ভয়াবহ ক্রাইম থ্রিলার। অন্য দুটি ট্র্যাজেডি না কমেডি বোঝা যাচ্ছে না। যারা একসময় ছিলেন দুর্ধর্ষ ক্ষমতাবান, এখন তাদের পক্ষ নেওয়ার লোক মিলছে না। মানুষ হাসছে, ফেসবুকে টিটকিরি মারছে। একসময়কার নিষিদ্ধ বিষয়গুলো নিয়ে জবরদস্ত কথাবার্তা বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে। এবং গুজব সত্যি বলে দেখা দিয়েছে। ভারতে এমপি আজীমের নৃশংস হত্যাকাণ্ড, সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদের বিপুল সম্পদের পাহাড় এবং সাবেক সেনাপ্রধান আজিজ আহমেদের দুর্নীতিতে জড়ানোর অভিযোগ এখন সংবাদমাধ্যমের প্রধান খোরাক।
আদার সঙ্গে কাঁচকলা মেশালে ভীষণ দুর্গন্ধ হয়। যিনি মানি মেকার তিনি রুল মেকার হলে কী হয়, এমপি আজীম তার মর্মান্তিক উদাহরণ। মাফিয়ার আইনপ্রণেতা বনে যাওয়াই শেষ নয়। এই গল্পে বিপুল পরিমাণ স্বর্ণ আছে, আন্ডারগ্রাউন্ড অপরাধচক্র আছে, আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ক আছে, আর আছে নারী। নারী, স্বর্ণ এবং ক্ষমতা এক জায়গায় হলে সেখানে অপরাধ এবং বিপর্যয় ঘটবেই।
খেয়াল করা দরকার, গত এক দশকের অনেক মারাত্মক অপরাধচক্রের কারবারের মধ্যে একটা ব্যাপার কমন ছিল: উচ্চাভিলাষী পুরুষদের সঙ্গে সুযোগসন্ধানী নারীদের বিশেষ রকমের সম্পর্ক। পাপিয়া-সম্রাট থেকে শুরু করে সাহেদ-সাবরিনার কাহিনি আমরা জানি। আরও অনেক কিছুই পরে জানা যাবে বলে ধরে নেওয়া যায়। কোনো নারী জেলে গেছেন, কোনো নারী সেলিব্রিটির আসন আলো করে বসে আছেন, কোনো নারী খুন হয়েছেন, কোনো নারী পুরস্কৃত হয়েছেন। ক্রিমিনাল অর্থনীতির চেরাগ যার হাতে তার চারপাশে এই ধরনের নারীপতঙ্গ ভিড় করছেন। নারী হয়ে উঠেছে রাজনীতি, ব্যবসা ও ক্ষমতার কারবারের বিশেষ রকম আকর্ষণীয় মুদ্রা। এই নারী-মুদ্রা বিনিময়ের ঘটনায় অঘটনও কম ঘটেনি। সব বলাও যায় না, দেখাও যায় না।
ঘূর্ণিঝড়ে সব হারানো মানুষ, অর্থনীতির ছন্নছাড়া দশায় কষ্টে থাকা মানুষ এসব ঘটনার দিকে তাকিয়ে কী ভাবছে? হয়তো ভাবছে, এসব চরিত্রের অন্যায় ও দুর্নীতির জন্যই মানুষের এত কষ্ট! বাংলাদেশের মানুষ এখন পিঁপড়ার মতো দৃষ্টি মাটির দিকে রেখে জীবনটা পার করে দিতে চায়। বড় রকমের বাধ্য না হলে ক্ষমতার মগডালে বসা পাখিদের দিকে তারা আর তাকায় না। এখন তারা মাথা তুলে দেখছে তাদের ভাগ্যবিধাতাদের কয়েকজনের আসল চেহারা! তারা দেখছে, আন্তর্জাতিক স্বর্ণ চোরাচালানি কোন ফাঁকে এমপি হয়ে বসে গেছেন। আবার সেই চোরাচালানের ভাগবাটোয়ারা নিয়ে দ্বন্দ্বে নৃশংসভাবে খুনও হয়ে যেতে হলো তাঁকে। তারা দেখছে আইন রক্ষার ভার ছিল যাঁর ওপর, দেশরক্ষার ভার ছিল যাঁর ওপর, তারা আসলে পরিবারের সম্পদ বাড়ানো এবং ভাইবেরাদরদের অপরাধ ঢাকতেই ব্যস্ত ছিলেন।
পাশ্চাত্যের জগৎ শেঠেরা স্পেসশিপে করে মহাকাশে বেড়িয়ে আনন্দ করেন। আমাদের দেশের বড়লোকদের সামনে নারী ও মদ ছাড়া আনন্দের উপকরণ তেমন নাই। আইনভঙ্গের চাইতে বড় বাহাদুরি আর কী আছে? ওদিকে আনন্দ মাফিয়াতন্ত্রের কাছে নারী খুবই আকর্ষণীয় মুদ্রা। রাজনীতিক কিংবা গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের বশে আনতে নারীকেই ব্যবহার করা হয় মোক্ষম কোমলাস্ত্র হিসেবে। সেই কোমলাস্ত্র ব্যবহার করেই এমপি আজীমের জন্য হত্যার ফাঁদ পাতা হয়েছিল বলে জানা যাচ্ছে।
এমপি আজীমের উত্থানের গল্পটা খেয়াল করুন। বিএনপি থেকে পাতি নেতা, পাতি নেতা থেকে এমপি এবং অবশেষে করুণ পরিণতি। একজন মাফিয়াকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে বড় ‘নেতা’ বানাতে লাগে ৫-৭ বছর। শুধু তাই নয়, বিশেষ রকমের নির্বাচন ব্যবস্থারও দরকার হয়। সুষ্ঠু নির্বাচনে সত্যিকার প্রতিদ্বন্দ্বী থাকে, তাদের জনপ্রিয়তার সঙ্গে সাধারণত মাফিয়ারা পাল্লা দিতে পারে না। বাংলাদেশের গত তিনটি নির্বাচন যে কায়দায় হয়েছে, সেখানে সত্যিকার জনপ্রতিনিধিদের চাইতে টাকার গরম, ক্ষমতার গরমঅলাদের সুযোগ বেশি। এটা নিশ্চিত করেই বলা যায়, গণতান্ত্রিক পরিবেশে এ ধরনের লোকেরা এমপি হতে পারতেন না।