বাজেট পেশের আগে পরিস্থিতি আরও জটিল এবার
৬ জুন নতুন অর্থবছরের বাজেট পেশ করা হবে। এর রূপরেখা সম্পর্কেও মিলেছে ধারণা। বাজেট প্রত্যাশামতো অনেক কম হারে বাড়ছে এবার। তবে রাজস্ব ব্যয় কম বাড়ছে না। উন্নয়ন ব্যয় (এডিপি) বাড়ছে খুবই কম। ‘সতর্কতার সঙ্গে’ প্রকল্প গ্রহণের কথা বলা হয়েছে। এতে স্বীকৃতি রয়েছে– কাজটা এতদিন যথেষ্ট সতর্কভাবে করা হয়নি। ছোট বাজেটই যেহেতু নেওয়া হচ্ছে, তাই উচিত নয় কি রাজস্ব ব্যয়টাও, বিশেষত পরিচালন ব্যয় বেশি বাড়তে না দেওয়া? তবে খাদ্য নিরাপত্তা জোরদারের পদক্ষেপ থাকছে। এ খাতে ব্যয় বাড়বে। উচ্চ মূল্যস্ফীতি পরিস্থিতিতে সেটাই স্বাভাবিক।
চলতি বাজেটে মূল্যস্ফীতির যে লক্ষ্যমাত্রা ছিল, পরিস্থিতি তার ধারেকাছেও নেই। বিশেষত উন্নয়ন সহযোগীরা যা বলছে, তাতে ধরে নেওয়া যায়– এটা আরও বাড়তে পারে। মূল্যস্ফীতি অবশ্য কমে আসবে একটা সময়ে। তবে সহসা কমার কারণ নেই। সাম্প্রতিককালে সুদ ও মুদ্রার বিনিময় হার বিষয়ে যে পদক্ষেপ নেওয়া হলো, তাতেও মনে করা হচ্ছে– মূল্যস্ফীতি কমবে না। এ অবস্থায় বাজেটে মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা সাড়ে ছয় শতাংশ করা হবে বলে জানা গেল। সেটা অনার্জিত হলে পরে সংশোধন করা হবে; যেমনটা করতে হয়েছে এবারও। চলতি অর্থবছরে প্রবৃদ্ধিও লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী হবে না। সরকারও এটা স্বীকার করছে।
বেসরকারি বিনিয়োগ একটা জায়গায় আটকে ছিল। এক্ষেত্রে দেখা দিচ্ছে কমার প্রবণতাও। শুধু সরকারি বিনিয়োগের ওপর তো প্রবৃদ্ধি বাড়ানো যায় না। সরকারি বিনিয়োগের মান নিয়ে সমালোচনাও কমছে না। এতে মানসম্মত আর টেকসই কাজের সুযোগ সৃষ্টি হয় না। নির্মাণসামগ্রীর ব্যবসা অবশ্য বাড়ে। ওইসব খাত চাঙ্গা হয়। তা সত্ত্বেও কর্মসংস্থান পরিস্থিতি যে খারাপ, সেটা অনস্বীকার্য। বিশ্বব্যাংক বলছে– এটা বেশ খারাপ। বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান পরিস্থিতি খারাপ এবং তার মধ্যে মূল্যস্ফীতি, বিশেষত খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের বেশি থাকলে তা উদ্বেগজনক বৈকি। এমন একটা অবস্থায় যে বাজেট পেশ হতে যাচ্ছে, তাতে স্বভাবতই মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনার প্রত্যয় ঘোষিত হবে। বলা হবে– সরকার এমন কিছু করবে, যাতে মূল্যস্ফীতি কমে আসে এবং কাজের সুযোগ বাড়ে।
অনেকদিন ধরেই মূল্যস্ফীতির চেয়ে মজুরি বৃদ্ধির হার কম। মূল্যস্ফীতির চেয়ে বেশি হারে আয় বাড়াতে সক্ষম মানুষ তো বেশি নেই দেশে। তারাই কেবল বলবে– পরিস্থিতি খারাপ নয়! তবে এ জনগোষ্ঠীর মধ্যে যারা উদ্যোক্তা, তারা কিন্তু টের পাচ্ছেন, পরিস্থিতি আসলে কেমন। দীর্ঘদিন ঋণের সুদের হার কম তথা নির্দিষ্ট সীমায় থাকায় তারা অবশ্য সুবিধা পেয়েছেন। তখন বিদেশ থেকেও ঋণ নিতে পেরেছেন কম সুদে। দেশে ডলারের দামটাও আটকে রাখা হয়েছিল। পরিবর্তিত বিশ্ব পরিস্থিতিতেও সরকার এসব নীতি নিয়েই চলতে চেয়েছে। তাতে অর্থনীতিতে সংকট ঘনীভূত হয়ে উঠলেও সুবিধা পেয়েছে একটি ব্যবসায়ী সম্প্রদায়। তবে সে পরিস্থিতি এখন আর নেই।
সুদের হারকে করা হয়েছে কমবেশি বাজারভিত্তিক। ডলারের আনুষ্ঠানিক দামও এখন বাজার দরের কাছাকাছি। সুদের হার সেভাবে আর না বাড়লেও ডলারের দাম আরও বাড়বে বলেই মনে হচ্ছে। এ অবস্থায় ব্যবসা পরিচালন ব্যয় বাড়বে। চলমান মূল্যস্ফীতিতে তাদের ওপর মজুরি বৃদ্ধির চাপও বাড়ার কথা। আন্দোলনের মুখে চা বাগানে মজুরি কিছুটা বাড়ানোর পর গার্মেন্টস শ্রমিকদের মজুরিও বাড়াতে হয়েছে। অন্যান্য আনুষ্ঠানিক খাতেও মজুরি বাড়ানোর দাবি সম্ভবত জোরদার হবে। সরকারকেও ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে হবে এ প্রশ্নে।
এরই মধ্যে নগরীতে অটোরিকশা চলাচল বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়ে সেটা আবার প্রত্যাহার করতে হয়েছে সরকারকে। এসব সংস্কার কার্যক্রম এগিয়ে নেওয়া ‘যুক্তিসঙ্গত’ হলেও তার বাস্তবতা এখন নেই। সরকার মেয়াদের শুরুতেই সাধারণত অপ্রিয় সংস্কার সেরে ফেলতে চায়। এ ফর্মুলাও এখন প্রয়োগ করা যাচ্ছে না। কারণ কোভিড উত্তরণের পর থেকেই মূল্যস্ফীতি বাড়ছে। আর মাসের পর মাস এটা থাকছে ১০ শতাংশের কাছাকাছি। এমন মূল্যস্ফীতি সামলাতে না পারার দায় স্বভাবতই বর্তাচ্ছে ১৫ বছর ধরে ক্ষমতায় থাকা সরকারের ওপর। আসছে বাজেটে যেমন; নতুন মেয়াদ শুরুর সময়েও সরকারকে তাই বলতে হয়েছে, মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনাটাই প্রধান লক্ষ্য।