গতানুগতিক বাজেটেও প্রত্যাশা থাকে
সবকিছু ঠিক থাকলে সপ্তাহখানেক পর জাতীয় সংসদে উপস্থাপিত হতে যাচ্ছে ২০২৪-২০২৫ সালের জাতীয় বাজেট। খুব সাদামাটাভাবে বললে, সরকারি বাজেট হচ্ছে একটি দেশের এক বছরের সম্ভাব্য আয়-ব্যয়ের হিসাব। সরকার আগামী এক বছর কোন কোন খাতে কত ব্যয় করতে চায়, এর বিবরণী ও প্রস্তাবনা। আবার এ ব্যয়নির্বাহ করার জন্য কোন কোন খাত থেকে আয় করতে চায়, তাও স্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকে। তবে সরকারি আয়ের বড় অংশই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ করের মাধ্যমে আসে। সেক্ষেত্রে সরকার তার করের পরিসীমা সম্প্রসারণ করতে পারে; প্রচলিত খাতগুলোয় করের আগের হার পরিবর্তন করতে পারে; কোনো কোনো পণ্য ও সেবার ওপর নতুনভাবে করারোপ করতে পারে।
আমাদের দেশে সাধারণত জুনের প্রথম সপ্তাহে অর্থমন্ত্রী সংসদে এ বাজেট উপস্থাপন করে থাকেন। প্রায় তিন সপ্তাহ জনপ্রতিনিধিরা এ বাজেটের ওপর আলোচনা করেন এবং কিছুটা সংশোধন, সংযোজন, বিয়োজন শেষে জুনের শেষ সপ্তাহে বাজেটটি অনুমোদন লাভ করে। ১ জুলাই থেকে অনুমোদিত বাজেটের কার্যকাল শুরু হয়, পরবর্তী বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত থাকে এর মেয়াদ। সংসদে অনুমোদনের কারণ হলো, জনগণের প্রতিনিধির মতামত ছাড়া কোনো করারোপ বৈধতা পায় না। এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট অর্থনীতি বিশ্লেষক আকবর আলি খানের ভাষ্যমতে, ‘‘রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও বাজেটের পরিবর্তন হচ্ছে। সাংবিধানিক দিক থেকে বাজেটের ভিত্তি হলো ‘No taxation without representation’, জনপ্রতিনিধিদের সম্মতি ছাড়া কোনো কর আদায় করা যাবে না। রাষ্ট্র পরিচালনায় জনগণের সম্মতির প্রয়োজনীয়তা ইংল্যান্ডে প্রথম স্বীকৃত হয় দ্বাদশ শতকে ম্যাগনা কার্টা বিদ্রোহের সময়। এ মতবাদ যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসী ইংরেজদের মধ্যে আরও ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। ১৭৬০-এর দশকে বোস্টন নগরীতে বিদ্রোহী মার্কিন নাগরিকরা এ মতবাদের ভিত্তিতে নতুন করারোপের বিরোধিতা করেন। ম্যাসাচুসেটসের গভর্নর ফরাসিদের সঙ্গে যুদ্ধের খরচ বহন করার জন্য অতিরিক্ত অর্থের প্রয়োজন বোধ করেন। তাই এশিয়া থেকে আমদানি করা চায়ের ওপর তিনি অতিরিক্ত কর বসান। বোস্টনের ব্যবসায়ীরা জনপ্রতিনিধিদের সম্মতি না নেওয়ায় এ কর দিতে অস্বীকৃতি জানান এবং আমদানি করা চায়ের বাক্স সমুদ্রে নিক্ষেপ করেন। এখানেই শুরু হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতাসংগ্রাম’ (বাংলাদেশের বাজেট : অর্থনীতি ও রাজনীতি, পৃ. ১৯-২০)।
সুতরাং বাজেট জনপ্রতিনিধিদের সম্মতি ছাড়া বৈধতা পাবে না। তাই সংসদে চলে মাসব্যাপী বাজেট পর্যালোচনা। এ বিষয়ে কেউ কেউ প্রশ্ন তুলতে পারেন এই বলে যে, সংসদে আমাদের যারা জনপ্রতিনিধিত্ব করেন, তারা প্রকৃত অর্থে মোট জনসংখ্যার কত অংশের প্রতিনিধি? কিংবা পেশাগতভাবে কোন শ্রেণির প্রতিনিধিত্ব করেন? সেই শ্রেণি দ্বারা সার্বিক সমাজের কল্যাণ রক্ষিত হবে কি? প্রশ্নগুলো অবান্তর নয়; তবে আজকের আলোচনায় আমরা সেদিকে যাব না। সবকিছু মেনে নেওয়ার পরও আগামী বাজেটে আমরা কী প্রত্যাশা করতে পারি, এর একটি খণ্ডিত চিত্র তুলে ধরার চেষ্টা করছি।
এ কথা ঠিক, আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধের মূলনীতি ছিল-সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামজিক ন্যায়বিচার। যে কোনো বাজেট প্রণয়নের ক্ষেত্রেই মূল চেতনাকে অনুসরণ করা উচিত। কিন্তু বলতে দ্বিধা নেই, ৫ দশকেরও বেশি সময় জাতীয় সংসদে যেসব বাজেট অনুমোদিত হয়েছে, তাতে মুক্তিযুদ্ধের তথা সাম্যের কোনো অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যাবে না। আপনার-আমার এ অভিমান-অনুযোগ শাসকগোষ্ঠীকে সামান্যতম বিচলিত করবে না। এ কারণে যৌক্তিক প্রত্যাশার দৈর্ঘ্য যতটা সম্ভব ছোট রাখার চেষ্টা করছি।
এটা ঠিক, বার্ষিক বাজেটের সঙ্গে সরকারের ভবিষ্যৎ কর্মসূচির সম্পর্ক থাকে। তবে বার্ষিক বাজেটের প্রধান লক্ষ্য থাকে চলমান সংকট মোকাবিলা ও নিরসন করা। যে সময় আসন্ন অর্থবছরের বাজেটটি উপস্থাপিত হবে, সে সময় অর্থনীতিতে নানা রকমের সংকট চলছে। দ্রব্যমূল্য আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে, ডলার সংকট প্রকট হয়ে উঠেছে, কালোটাকার পাহাড় জমে গেছে, অর্থ পাচার রোধ করা সম্ভব হচ্ছে না, ঋণখেলাপিদের দৌরাত্ম্যে লাগাম টানা যাচ্ছে না, আয়বৈষম্যে ঊর্ধ্বগতি ইত্যাদি। এসব সমস্যা-সংকটের সমাধানকে সামনে রেখে যদি বাজেট প্রস্তাব করা না হয়, তাহলে সে বাজেট কোনো কার্যকর ফল বয়ে আনবে না।