জেন্ডার ও আইডেনটিটি ক্রাইসিস
অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী রুমানা, চতুর্থ শ্রেণির সূর্য এবং ষষ্ঠ শ্রেণির সাগর (সবগুলো ছদ্মনাম)—এই তিন শিশুর ঘটনা আলাদা হলেও একসূত্রে গাঁথা। রুমানা মেয়ে হয়েও ছেলেদের মতো আচরণ করে। সূর্য ও সাগর ছেলে হয়েও আচরণ ও ভাবভঙ্গি মেয়েদের মতো এবং বন্ধুদের বুলির শিকার হয়। রুমানা ও সূর্যের অভিভাবকেরা বিষয়টি ‘ফালতু শখ’ হিসেবে বিবেচনা করেন এবং স্কুল থেকে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে বলায় তাদের অন্য বিদ্যালয়ে নিয়ে গেছেন।
সাগরের অভিভাবক নিজেরা এমনিতেই সচেতন ছিলেন, ডাক্তার দেখিয়েছেন এবং হরমোনের ভারসাম্যজনিত সমস্যা আছে বলে জেনেছেন। পরিবার ও বিদ্যালয়ের বিশেষ সহযোগিতায় সে তার সমস্যা মেনে নিয়ে সহজভাবে চলতে শিখছে। সম্ভবত অভিভাবকদের মনস্তাত্ত্বিক সমস্যা এসবকে সমস্যা মনে না করা।
সাধারণভাবে জন্মকালে লিঙ্গ-পরিচয় নির্ধারিত হয় নবজাতকের জননেন্দ্রিয় অনুসারে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এই লিঙ্গ-পরিচয় বার্ধক্য পর্যন্ত অপরিবর্তিত থাকে। ফলে সাধারণ মানুষ লিঙ্গ-পরিচয় ও প্রজননের ভূমিকার মধ্যে কোনো পার্থক্য স্বীকার করতে চায় না। কিন্তু সব অভিধান লিঙ্গ-পরিচয় ও প্রজননের ভূমিকা বা যৌন-পরিচয় ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করে। লিঙ্গ-পরিচয় নিয়ে বিশ্বব্যাপী মতামতের বৈচিত্র্য এমনই যে নর ও নারী ছাড়া আর কোনো সর্বজনস্বীকৃত বিভাজনরেখা টানা এখন পর্যন্ত সম্ভব হয়নি।
তবে চার ধরনের লিঙ্গের ক্ষেত্রে ঐকমত্য পাওয়া যায়। নর ও নারী ছাড়া আরও দুই দল—একদল নর ও নারী মিশিয়ে নিজের পরিচয় দিতে পারে (কিন্তু উভয় লিঙ্গ বা হার্মোফ্রোডাইট বলা হয় না) এবং অন্য দল নর বা নারীর কোনো পরিচয়ই দিতে রাজি নয়। মনে রাখতে হবে, যৌন আচরণ (সেক্সুয়াল ওরিয়েনটেশন) ও প্রজননের ভূমিকাও আলাদা বিষয়। বিভিন্ন কারণে এখন আর এই ধারার বিভাজন মানা হয় না।
ট্রান্সজেন্ডার ও হিজড়া
ব্রিটেনিকা, অক্সফোর্ড, কলিন্স ও কেমব্রিজ অভিধানে ট্রান্সজেন্ডার অর্থ বা সংজ্ঞা হিসেবে যা লিখেছে তা এককথায়—যেসব মানুষের লিঙ্গ-পরিচয় জন্মকালের লিঙ্গ-পরিচয় থেকে ভিন্ন, তারাই ট্রান্সজেন্ডার। তবে অভিধানে ট্রান্সজেন্ডারের ব্যাখ্যায় অনেক উপবিভাজনের উল্লেখ আছে। প্রকৃত অর্থে সমাজে পৌরুষ বা নারীত্বের প্রচলিত রূপের মাঝখানের স্পেকট্রাম অনেক বিস্তৃত। এই স্পেকট্রামের সবটাই বা কতটুকু ট্রান্সজেন্ডার, তা নিয়ে দ্বিমত বা বহুমত আছে এবং কোন অংশকে হিজড়া বলা হবে, তা নিয়েও নানা মুনির নানা মত। গুগল বা অনলাইন অভিধান থেকে হিজড়ার ইংরেজি পাওয়া যাবে ট্রান্সজেন্ডার। কিন্তু নৃবিজ্ঞানীরা হিজড়া ও ট্রান্সজেন্ডারকে আলাদাভাবে দেখেন। লক্ষণীয়, হিজড়া প্রমিত শব্দ হিসেবে বিবেচনা করা না হলেও এটি ভারতীয় অঞ্চলের একটি বহুল প্রচলিত শব্দ।
অন্যদিকে ইংরেজি ভাষায় শব্দ হিসেবে ট্রান্সজেন্ডার প্রথম ব্যবহার করা হয়েছে ১৯৭৪ সালে (অক্সফোর্ড) অথবা ১৯৮৮ সালে (কলিন্স)।অন্যদিকে গুগল সার্চ করে মাত্র ৯টি ভাষায় ট্রান্সজেন্ডারের প্রতিশব্দ পাওয়া গেছে, অর্থাৎ বাংলা ভাষার মতো অনেক ভাষাতেই ট্রান্সজেন্ডারের প্রতিশব্দের প্রয়োজন হয়নি। আগে সম্ভবত ‘উভয় লিঙ্গ’ (হার্মাফ্রোডাইট) শব্দ ব্যবহার করা হতো। জীববিজ্ঞানে হার্মাফ্রোডাইট শব্দের ব্যবহার থাকলেও মানুষের ক্ষেত্রে এই শব্দ ব্যবহার করা হয় না। তবে চিকিৎসাশাস্ত্রে মানুষের বেলায় ‘উভয় লিঙ্গ’ শব্দটির ব্যবহার এখনো আছে। সহজেই অনুমেয়, ট্রান্সজেন্ডারের ধারণা একেবারেই ইদানীং কালের বিষয়, যার সর্বজনগৃহীত ব্যাখ্যা এখনো প্রতিষ্ঠা পায়নি। আরও লক্ষণীয়, এসব বিষয়ের কিছু ক্ষেত্রে চিকিৎসাশাস্ত্র ও নৃবিজ্ঞান ঐকমত্যে আসতে পারেনি।