একটি প্রেমপত্র ও নজরুল
কাজী নজরুল ইসলাম মানুষটা ধর্মকর্ম খুব একটা মানতেন বলে প্রমাণ পাওয়া যায় না। বিয়ে করেছেন জাত-ধর্মের ঊর্ধ্বে উঠে। কবিতায় লিখেছেন, ‘বিধি ও নিয়মে লাথি মেরে, ঠুকি বিধাতার বুকে হাতুড়ি।' বলেছেন, ‘স্রষ্টারে আমি চুষে খাই!... ভগবানে আমি পোড়াব বলিয়া জ্বালায়েছি বুকে চিতা!' বলেছেন, ‘হৃদয়ের চেয়ে বড় কোনও মন্দির-কাবা নাই।’ তিনি ভজন লিখেছেন, কীর্তন লিখেছেন। লিখেছেন গজল।
আমরা নজরুলকে বুঝলাম আমাদের মতো করে। আমরা ভুলে গেলাম নজরুলের সেই মহান বাণী, ‘গাহি সাম্যের গান, মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নাই কিছু মহীয়ান।’
আমরা 'মসজিদেরই পাশে আমায় কবর দিও ভাই'— এই কথাটিকেই নজরুলের একমাত্র 'আদর্শ' হিসেবে চালালাম!
নজরুলের ১২৫তম জন্মবার্ষিকীতে দাঁড়িয়ে আজ কেবলই মনে হচ্ছে, তিনি সম্ভবত পৃথিবীর সবচেয়ে বড় দুর্ভাগা ব্যক্তি যার চিন্তা-চেতনা-আদর্শকে অনেক বেশি ভুল বোঝা হয়েছে, ভুল ‘অনুবাদ’ করা হয়েছে!
আমরা ভুলে যাই দ্রোহ-বিদ্রোহের ঊর্ধ্বে নজরুলের প্রেমময় জীবনের কথা। তার প্রেমিক রূপটিও প্রবাদপ্রতিম। তাই মানুষটি অনায়াসেই বলতে পারেন ‘আমার আপনার চেয়ে আপন যে জন খুঁজি তারে আমি আপনায়।’ পৃথিবীতে এমন কয়জন আছেন যিনি প্রেমের টানে রক্তের সর্ম্পককে অস্বীকার করে পথে বেরিয়ে পড়তে পারেন? নজরুলের জীবনে প্রেম এসেছিল বারবার—কখনো ঝড়ের মতো, কখনো নিভৃতে। তাই তো জীবনের শেষ ভাষণে কবি বলেছিলেন: ‘আমি কবি হতে আসিনি, আমি নেতা হতে আসিনি; আমি প্রেম দিতে এসেছিলাম, প্রেম পেতে এসেছিলাম।’
নজরুলের প্রণয়-পর্ব সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায় নার্গিসকে লেখা এক চিঠিতে। হৃদয়ে কতটা প্রেমের ফল্গুধারা বইলে এমন চিঠি লেখা যায়, তা এই চিঠিটি বিশ্লেষণ না করলে বোঝা যাবে না।
১৯২১ সাল৷ কিছুদিন কুমিল্লায় খেয়ালি সময় কাটিয়ে একপ্রাণ ছুটি আর অপ্রত্যাশিতের আকাঙ্ক্ষা নিয়ে কাজী নজরুল ইসলাম এলেন দৌলতপুরের এক গ্রামের বাড়িতে৷ বাড়িটি আলী আকবর খানের৷ বাড়ির কর্ত্রী আকবর খানের বিধবা বড় বোন৷ আকবর সাহেবের আর এক বোনও থাকেন ওই গ্রামেই৷ তিনিও বিধবা৷ তার সুন্দরী মেয়ে সৈয়দা খাতুন মাঝেমধ্যেই আসে আকবর খানের বাড়িতে৷ সেখানেই এক বৈশাখ-অপরাহ্নে এই সুন্দরীর দেখা হলো নজরুলের সঙ্গে৷ কবির মধ্যে অপ্রত্যাশিতের তৃষ্ণা উসকে দিল সুন্দরী৷ নজরুল লিখলেন–
“সে যেন কোন দূরের মেয়ে আমার কবি মানস বধূ্
বুক-পোরা আর মুখ-ভরা তার পিছলে পড়ে ব্যথার মধু!
নিশীথ-রাতের স্বপন হেন,
পেয়েও তারে পাইনে যেন,
মিলন মোদের স্বপন-কুলে কাঁদন-ভরা চুমায়-চুমায়৷
নাম হারা সেই আমার প্রিয়া, তারেই চেয়ে জনম গোয়ায়৷”
এই মেয়েই নজরুলের নার্গিস! নার্গিস অসাধারণ সুন্দরী৷ তোলপাড় ভালোবাসলেন নজরুল ইসলাম৷ এতই কাছাকাছি হলেন তারা, দুজনের বিয়েও ঠিক হয়ে গেল৷ সে-খবর কলকাতার বন্ধুদের জানালেন কবি৷ এক বন্ধু সেই চিঠি পেয়ে লিখলেন, ‘তোর চিঠিতে জানলুম তুই স্বেচ্ছায় সজ্ঞানে তাকে বরণ করে নিয়েছিস৷ তবে একটা কথা, তোর বয়েস আমাদের চেয়ে ঢের কম৷ অভিজ্ঞতাও তদনুরূপ৷ কাজেই ভয় হয় যে, হয়তো বা দুটো জীবনই ব্যর্থ হয়৷’ ১৯২১-এ নজরুল ঠিক বাইশ৷ বন্ধুকে জানালেন তিনি, ‘এক অচেনা পল্লী বালিকার কাছে এত বিব্রত ও অসাবধান হয়ে পড়েছি, যা কোনও নারীর কাছে কখনও হইনি৷’ নজরুলের সঙ্গে নার্গিসের বিয়ের লগ্ন ঠিক হল ‘১৩২৮-এর ৩রা আষাঢ়, শুক্রবার, নিশীথ রাতে৷’