
নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি ক্রমাগত কমছে
ষষ্ঠ উপজেলা নির্বাচনের প্রথম পর্ব অনুষ্ঠিত হওয়ার পর প্রায় সবারই ধারণা ছিল যে দ্বিতীয় পর্বে ভোটার উপস্থিতি উল্লেখযোগ্য হারে বাড়বে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার যদিও দাবি করেছেন যে কিছুটা ভোটার উপস্থিতি বেড়েছে, কিন্তু কত শতাংশ ভোটার বেড়েছে, তা তিনি নিশ্চিত করতে পারেননি। উপজেলা নির্বাচনে কারা জয়লাভ করেছেন কিংবা কারা করতে পারেননি, তা খুব একটা আলোচনায় আসে না। আলোচনায় গুরুত্ব পায় ভোটারের উপস্থিতি কতটা বেড়েছে। ভোট শান্তিপূর্ণ হচ্ছে—এমনটি ভোটাররাও দাবি করছেন। কিছু কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটলেও বড় ধরনের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির ঘটনা কোথাও ঘটেনি। বিএনপি ও এর সমমনা দলগুলোর প্রার্থীরা নির্বাচনে যাতে কোনোভাবেই অংশ নিতে না পারেন, সে জন্য দল থেকে বহিষ্কার করার কঠোর অবস্থানে তারা রয়েছে। তার পরও বিএনপির বেশ কিছুসংখ্যক প্রার্থী স্বতন্ত্রভাবেই নির্বাচন করেছেন। বিএনপি সমর্থকদের একটি অংশ স্থানীয় পর্যায়ে ভোট প্রদান করছেন, তা সবারই জানা বিষয়। তার পরও উপজেলা নির্বাচনে যদি সব দল অংশগ্রহণ করত, তাহলে ভোটার উপস্থিতি বর্তমানের দ্বিগুণের চেয়েও বেশি হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। যেহেতু নির্বাচনে অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে বিরোধীদের সামনে দল বড় ধরনের ব্যারিকেড দিয়ে রেখেছে, তাই তাদের অংশগ্রহণ এবং ভোটদানের ইচ্ছাশক্তিকে দমন করা ছাড়া অনেকের পক্ষেই করার কিছু নেই। তবে প্রধান বিরোধী দল বিএনপির নিষেধাজ্ঞাও উপেক্ষিত হতো, যদি আওয়ামী লীগ দলীয়ভাবে নিজেদের নেতা-কর্মীদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারত। এতে নির্বাচনের দৃশ্যপটে বেশ কিছু পরিবর্তন ঘটার সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের কারণে ভোটের পালে হাওয়া তীব্রতর করা খুব একটা সম্ভব হয়নি। এর ব্যাখ্যা দেওয়া যেতে পারে।
প্রথম ও দ্বিতীয় পর্বে বেশ কিছু প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। যাঁরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন, তাঁরা প্রতিদ্বন্দ্বী কেউ থাকুক—এমনটি নিশ্চয় চাননি। কীভাবে নিজের একক প্রার্থিতা নিশ্চিত করেছিলেন, তা মনে হয় খুব বেশি বুঝিয়ে বলার দরকার নেই। কোথাও কোথাও চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান ও মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে একই ধরনের প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীনতা কীভাবে তৈরি হয়েছে, তা স্থানীয় নেতা-কর্মীরা জেনেও না জানার ভান করেন। অথচ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলীয় সভাপতি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় কোনো প্রার্থী যেন নির্বাচিত না হতে পারেন তা নিশ্চিত করেছিলেন। কিন্তু উপজেলা নির্বাচনে সেটি করা সম্ভব হয়নি। অথচ এখানে প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচনে কোনো ব্যত্যয় দল থেকে অনুমোদন কিংবা প্রশ্রয় দেওয়া একেবারেই প্রত্যাশিত ছিল না। যেসব উপজেলায় এমন ঘটনা ঘটেছে, সেখানে ভোটারের আগ্রহ সহজেই নির্বাচন থেকে সরে গেছে। এ ছাড়া মন্ত্রী, এমপি এবং প্রভাবশালীদের সমর্থিত প্রার্থী থাকায় প্রতিটি উপজেলায় প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর সংখ্যা খুবই সীমিত হয়ে গেছে।
অনেক ক্ষেত্রেই দু-তিনজনের বেশি প্রার্থী একেকটি পদে প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে ছিলেন না। অথচ প্রতিটি উপজেলা থেকে যোগ্য ও জনপ্রিয় অন্তত অর্ধ ডজন প্রার্থী একেক পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলে গোটা উপজেলাতেই নির্বাচনী আবহ উত্তপ্ত হয়ে উঠত। উপজেলা নির্বাচনে প্রতিটি এলাকার ভোটাররা নিজেদের পরিচিত মুখ দেখতে চান। কিন্তু আওয়ামী লীগের যাঁরা প্রার্থী হয়েছেন, তাঁরা প্রথমত প্রতিদ্বন্দ্বী কাউকে রাখতে চাননি, থাকলেও সংখ্যাটা যেন ২-৩-এর বেশি না হয় এবং শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী কেউ নির্বাচনে দাঁড়াক, সেটিও অনেকে চাননি। নিজের বিজয় নিশ্চিত করার জন্য নির্বাচনকে হাওয়াহীন করে তুলতে যা যা দরকার ছিল, তা অনেকেই করেছেন। গোটা উপজেলায় যোগ্য এবং ভোটারদের সমর্থিত প্রার্থী হওয়া বা করার ক্ষেত্রে আগ্রহ না থাকায় নির্বাচনে ভোটারদের আগ্রহ অনেকটাই কমে গেছে। প্রার্থীদের কর্মীদের মধ্যেও ভোটার টানার প্রবণতা দেখা যায়নি। এসব নানা হিসাব-নিকাশ উপজেলা নির্বাচনে যেভাবে কাজ করেছে, তাতে বিজয়ী প্রার্থীরা বেজায় খুশি আছেন। বরং ভোটার বেশি হলে তাঁদের কারও কারও চক্ষুশূল বেড়ে যেত, হয়তো বেড়েও গেছে। ফলে উপজেলা নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি নির্বাচন কমিশন কিংবা গণমাধ্যমের চাপে আরও বেশি হওয়া আশাব্যঞ্জক হলেও প্রার্থীদের কাছে তা মোটেও ছিল না। তাদের কাছে যত কম ভোটার উপস্থিতিতে বিজয় নিশ্চিত করা যায়, ততটাই নিরাপদ বলে মনে হয়েছে। ভোটকেন্দ্রে ভোটার আনা-নেওয়ার ক্ষেত্রে কারও কারও বিশেষ পছন্দ ছিল। সেটিই তাঁরা প্রয়োগ করেছেন বলে বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা গেছে।
- ট্যাগ:
- মতামত
- উপস্থিতি
- উপজেলা পরিষদ নির্বাচন
- ভোটার