কোথায় স্বর্গ কোথায় নরক?
যারা মনে করেন আমরা বিদেশে স্বর্গে বসবাস করি তাদের ধারণা ভুল। একটা সময় আমিও তা মনে করতাম। কিছুদিন আগেও ভাবতাম এখানে জিনিসপত্র কত সস্তা। সবাই যা খুশি তা কিনতে পারে । এখন আর পরিস্থিতি তেমন নেই। বদলে যাওয়া বিশ্বে সব দেশ সব জাতিই আসলে ধুঁকছে। ছবি দেখে বা ভিডিও দেখে মনে হতে পারে, আরে এরা তো দিব্যি স্যুট-টাই, কোট-প্যান্ট পরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সমস্যা কোথায়?
সমস্যা আছে। আপনি যদি ভেতরে প্রবেশ না করেন বুঝতে পারবেন না। এখানকার চার্চ বা গির্জাগুলো সপ্তাহান্তে এমনকি সপ্তাহের কোন কোন দিন দাতব্য কাজে খোলা থাকে। সকাল থেকে গরম সসেজ রুটি টোস্ট ডিম ভাজি চা কফি বানিয়ে রাখে তারা। তারা জানে মানুষ আসবেই। মানুষের প্রয়োজন আছে আসার। এমন চ্যারিটি বহু জায়গায় এখন সংকুলান করতে পারছে না। না খাবার, না ভিড়ের। ভিড় যে খুব চোখে পড়ার তা নয়, কিন্তু আছে। একটা সময় এই কবছর আগেও আমি কাউকে হাত পেতে কিছু নিতে দেখিনি। নিলেও তা হাতে গোণা। এখন রাস্তায় পয়সা নিয়ে গান করা বা কাগজে নিজেকে দুঃস্থ লিখে বসে থাকা মানুষ বাড়ছে । বছরখানেক ধরে যেমনটা দেখছি, সিডনিতে আমি এর আগের ২০ বছরে কখনো এতো অভাবী মানুষ দেখিনি। দারিদ্র্যের ঢেউ আমেরিকা-ইউরোপজুড়ে বিস্তৃত হচ্ছে বলে জানতে পাচ্ছি।
আমার নিজের একটা ঘটনার কথা বলি। ভোর সকালে মানুষ ঘুম থেকে ওঠার আগেই কাজে যেতাম । এত সকাল বেলা আর যাই হোক সাজগোজ চলে না। মাথার চুল থাকে উস্কোখুস্কো। গলার কলার কোটের ভাঁজও হয়তো অবিন্যস্ত। সে দিন সকালে শপিং মলের চেইন শপে দেখি চল্লিশোর্ধ এক মহিলা খাবার কিনে যতবার টাকা দেয়ার চেষ্টা করছিল তার কার্ড কাজ করছিল না। ম্যাসেজ ছিল একাউন্টে টাকা নেই। আমি আর কখনো কাউকে এতটা বেপরোয়া দেখিনি । মুখ কালো করে বেরিয়ে যাবার সময় বারবার বলছিল আমার খুব খিদে পেয়েছে। আমি কিছু খেতে চাই। আমি জানি তার খাবার জুটে যাবে। কিছুটা এগিয়ে বিখ্যাত চেইনশপ খাবারের দোকানগুলোতে জুটে যাবে কিছু না কিছু। অনেকেই জানেন আজকাল ইউরোপেরও নানান দেশে একটা সিস্টেম চালু হয়েছে। দারুণ এটি।
যেমন ধরুন আমি যদি একটা মিল কিনি তাতে বার্গার চিপসসহ যে কোন ড্রিংকস থাকে। এখন আমি যেহেতু চা-খোর ফানটা কোকের বদলে চা চেয়ে নিই। এর সঙ্গে আমি আর একটা জিনিস ফ্রি পাব। ষাট পেরুলে যে কোন সিনিয়র সিটিজেনের জন্য বাকি ড্রিংকসটা ফ্রি। এখন আমি দুটো পানীয় দিয়ে কি করব? আমি বলে দিতে পারি ওই এক কাপ কফি বা চা তোমার কাছে জমা থাক। কোন দুঃস্থ বা তেমন কেউ এসে চাইলে তুমি সেটা তাকেই দিও। শুধু ফ্রি কেন আপনি চাইলে নিজের খাবার কেনার সময় এমন কিছু ডোনেট করতেই পারেন। যারা বিক্রেতা বা দোকানে কাজ করে সেসব তরুণ-তরুণীরা হিসাব রাখে এবং ঠিকই কাউকে না কাউকে তা দিয়ে দেয় ।
বলছিলাম সে দিনের ভোর বেলার কথা। আমি একটুকরো বেনানা কেক কিনে দাম চুকাতে গিয়ে শুনি আমার ও টাকা কম আছে। হতেই পারে। সব টাকা তো আর এক একাউন্টে থাকে না। আমি সরে দাঁড়িয়ে একটু দূরে গিয়ে মোবাইলে আমার পাসওয়ার্ড ঠিক করছিলাম। যাতে কিছু ডলার সে একাউন্টে পাঠাতে পারি। এ বিষয়ে সাবধানতা ও গোপনীয়তার জন্যই দূরে সরে যাওয়া। ফিরে আসতেই কাউন্টারের মেয়েটি আমার হাতে কেকটা ধরিয়ে দিয়ে বলল, বাই। আমি তাকে বললাম, আমি তো টাকা দিইনি। দাঁড়াও টাকা দিই আগে। সে আমাকে অবাক করে দিয়ে জানিয়েছিল আর একজন মানুষ টাকাটা দিয়ে চলে গেছেন। আমি সে মানুষটিকে খুঁজেই পেলাম না। আমার দরকার না থাকলেও এই মানবিক সাহায্য আমাকে মুগ্ধ করেছিল ।
- ট্যাগ:
- মতামত
- মানবিক সহায়তা