বিদ্যুৎ নিয়ে সরকারের অনেক চ্যালেঞ্জ
একাধিক কারণে বিদ্যুতের বিষয়টি বারবার আলোচনায় আসছে। প্রথমত, ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে আবারও তাপপ্রবাহ শুরু হয়েছে এবং তা সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ছে। ফলে বিদ্যুতের চাহিদা সর্বোচ্চ পর্যায়ে উঠবে এবং দেশের অনেক জায়গায় অসহনীয় লোডশেডিংয়ের আশঙ্কা রয়েছে। দ্বিতীয়ত, আসন্ন জাতীয় বাজেট সম্পর্কে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ের আলাপ-আলোচনায় জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) আমদানি করা সব ধরনের জ্বালানির ওপর শুল্ক বসাতে এবং বাড়াতে চায় বলে একটি কথা শোনা যাচ্ছে। তৃতীয়ত, মার্কিন ডলারের সরকারনির্ধারিত দাম একলাফে সাত টাকা বাড়িয়ে দেওয়ায় টাকার বড় ধরনের অবমূল্যায়ন হয়েছে, যার প্রভাব বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাতে অবধারিতভাবে পড়বে। চতুর্থত, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণের শর্ত হিসেবে এ খাতে সরকারের ভর্তুকি তুলে দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।
এই কারণগুলো বিদ্যুৎ খাতে সরকারের সামনে অনেক চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করেছে। আর সরকার চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ায় বিদ্যুতের গ্রাহকেরাও বিপাকে পড়তে যাচ্ছেন। অবশ্য গ্রাহকেরা এখনো যে খুব স্বস্তিতে আছেন, তা নয়। কেননা ২০১০ থেকে ২০২০ পর্যন্ত বিদ্যুতের দাম বেড়েছে নয়বার। আর গত দেড় বছরে বেড়েছে চারবার। সামনে যে চ্যালেঞ্জগুলো রয়েছে তারও অন্তর্নিহিত বিষয় দাম বৃদ্ধি। বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ ইতিমধ্যে গণমাধ্যমের কাছে বলেছেন, ডলারের দাম এবং সরকারের ভর্তুকি সমন্বয় করতে গিয়ে বিদ্যুতের দাম বছরে চার-পাঁচবার সমন্বয় করা হতে পারে। এরই প্রেক্ষাপটে বিদ্যুৎ খাতে সরকারের যে চ্যালেঞ্জগুলো গ্রাহকদেরও বিপাকে ফেলবে, সেগুলোর প্রতি দৃষ্টিপাত করা প্রয়োজন।
সরকারের প্রথম চ্যালেঞ্জ, চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ উৎপাদন। এ জন্য প্রথমেই প্রয়োজন প্রকৃত চাহিদা নিরূপণ করা। এটি করা হয়নি বলেই রেকর্ডভাঙা বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরও বাস্তবে অনেক এলাকায় লোডশেডিং করা হয়। কিন্তু খাতাপত্রে কোনো লোডশেডিং থাকে না। চাহিদা অনুযায়ী, বিদ্যুৎ উৎপাদনের সঙ্গে যুক্ত থাকে জ্বালানির প্রাপ্যতার ব্যাপারটিও। বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই। তবে প্রয়োজনীয় জ্বালানির (বিশেষ করে গ্যাস) অভাবে প্রায় চার হাজার মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতার বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ রাখতে হয় বলে এখন সবাই জানেন।
দ্বিতীয় চ্যালেঞ্জ, নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ। এ বিষয়টি জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (এসডিজি) অংশ। সরকার এসডিজিতে স্বাক্ষর করে এই লক্ষ্য অর্জনে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের সঙ্গে যুক্ত সঞ্চালন ও বিতরণব্যবস্থার সক্ষমতা। আমরা জানি, সঞ্চালনব্যবস্থার সীমাবদ্ধতার জন্য মাতারবাড়ী বিদ্যুৎকেন্দ্রের পূর্ণ উৎপাদন ক্ষমতা ব্যবহার করা যাচ্ছে না। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্ষেত্রেও একই সমস্যা হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। আর শহরাঞ্চলে বিদ্যুৎ বিতরণব্যবস্থার যথেষ্ট উন্নয়ন হলেও গ্রামাঞ্চলের সর্বত্র এখনো তা হয়নি। এটি না হলে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা সম্ভব হবে না।
তৃতীয় চ্যালেঞ্জ, বিদ্যুতের দাম। দাম মানে সব শ্রেণির গ্রাহকের কাছে বহনযোগ্য দাম (অ্যাফোর্ডেবল প্রাইস)। এই অ্যাফোর্ডেবল প্রাইসও এসডিজির অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু আমাদের দেশে বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির প্রবণতা সব শ্রেণির গ্রাহকের কাছে বহনযোগ্য বলা যাবে না। এখানে ২০১০ সালে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের গড় দাম ছিল ৩ টাকা ৭৩ পয়সা। ২০২৪ সালে তা হয়েছে ৮ টাকা ৯৫ পয়সা। বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রীর উপরোল্লিখিত বক্তব্য থেকে পরিষ্কার যে প্রতিবছর বিদ্যুতের দাম আরও বাড়বে (সমন্বয় করা হলে)। তারপরও মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির মতো অর্থনৈতিক পরিসংখ্যান দিয়ে হয়তো চেষ্টা করা হবে দাম বৃদ্ধি এবং অ্যাফোর্ডেবল প্রাইসের যৌক্তিকতা প্রতিষ্ঠার। কিন্তু বাস্তবতা হবে ভিন্নতর।
- ট্যাগ:
- মতামত
- বিদ্যুৎ খাত
- সরকারের চ্যালেঞ্জ