ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিয়ে আর কবে সতর্ক হব?
এপ্রিলজুড়ে নজিরবিহীন তাপপ্রবাহ বয়ে যাওয়ার সময়টায় আমরা চিন্তিত হয়েছি প্রধানত বোরোর উৎপাদন আর উত্তোলন নিয়ে। সেটাই স্বাভাবিক; কারণ এটা আমাদের প্রধান ফসল। বিশেষ করে আমরা চিন্তিত হয়ে খবর নিয়েছি সেচের। কৃষি বিভাগও বলছিল, জমিতে ধান পেকে না এলে তাপপ্রবাহের মধ্যে অবশ্যই কিছু পানি ধরে রাখতে হবে। খবর আসছিল-যশোর, চুয়াডাঙ্গা, কুষ্টিয়াসহ অনেক অঞ্চলে সাধারণ নলকূপে পানি উঠছে না। পর্যাপ্ত বৃষ্টি হলে এ সময়টায় অত সেচ অবশ্য দিতে হতো না। সেটা না হওয়াতেই সেচের চাহিদা বেড়েছে। একই সময়ে আবার ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নেমে গেছে অনেক।
জিকে সেচ প্রকল্প প্রায় অচল বলে আমরা খবর পাচ্ছিলাম আগে থেকেই। এর আওতাধীন অঞ্চলের কৃষকরা কীভাবে কী করছে, তার খোঁজ অবশ্য কমই নেওয়া হয়েছে। এসব এলাকায় গৃহস্থালিতে ব্যবহারের জন্য সুপেয় পানিও সহজে মিলছে না। যারা সাবমার্সিবল পাম্প দিয়ে অনেক গভীর থেকে পানি তুলতে সক্ষম, তাদের কাছে ভিড় বেড়েছে আশপাশের মানুষের। কারণ চাপকলে পানি মিলছে না। সাধারণ নলকূপে পানি উঠছে না বলে সেচেও সাবমার্সিবল পাম্পের ব্যবহার বেড়েছে বহু এলাকায়। এগুলো সাধারণভাবে কৃষিকাজে ব্যবহারের জন্য নয়। কিন্তু প্রয়োজন তীব্র হয়ে উঠলে প্রশাসনকেও থাকতে হয় চোখ বুঁজে। অনেক স্থানে সাবমার্সিবল পাম্পে উত্তোলন করা পানি কিনে সেচের ব্যবস্থা করছে ছোট কৃষক। এসব পাম্প অবশ্য বিদ্যুৎচালিত। সরাসরি সংযোগ না থাকলে ডিজেল জেনারেটরে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে তবু এগুলো ব্যবহার করছে মানুষ। এতে সেচ খরচ কতটা কমেছে না বেড়েছে, সে আলোচনা আছে। তবে সারা দেশে অনিয়ন্ত্রিতভাবে সেচযন্ত্র ব্যবহারের পর সাবমার্সিবল পাম্প ব্যবহারে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর আরও কতখানি নেমে গিয়ে কী পরিস্থিতি সৃষ্টি করছে, সেটাও বিবেচ্য।
প্রধান খাদ্যশস্য চালের জন্য যে মৌসুমের ওপর আমরা বেশি নির্ভর করি, সেই বোরো ফসলটা ব্যাপকভাবে সেচনির্ভর। অন্যান্য মৌসুমেও কম-বেশি সেচ লাগে; তবে বোরোর মতো নয়। এক্ষেত্রে এক কেজি চাল উৎপাদনে যে পরিমাণ পানি ব্যবহৃত হয়, তা জানলে সচেতন মানুষ মাত্রেরই মন খারাপ হবে। আর ভূউপরিস্থ পানির অভাবে সেটা যদি আহরণ করা হয় ভূগর্ভ থেকে এবং ক্রমে আরও তলদেশ থেকে, তাহলে ব্যাপারটা হবে দুশ্চিন্তার। দীর্ঘদিন দেশের বিপুলসংখ্যক কৃষক আবার অতিরিক্ত পানি তুলে জমিকে খাইয়েছে ভুল ধারণার বশবর্তী হয়ে। সে কারণেও ভূগর্ভের পানি বেশি করে উত্তোলনের চাহিদা হয়েছে তৈরি। এতে আবার বেশি বিদ্যুৎ ও ডিজেল খরচ হয়েছে; ব্যয়ও বেড়েছে কৃষকের। এখনো এ প্রবণতা নেই, বলা যাবে না। পানির দেশে এর অভাব কখনো হবে না, এরকম ধারণার বশবর্তী হয়েও আমরা পানির এ অপচয় রোধে উদ্যোগী হইনি। ব্যক্তিগত ব্যবহারেও অধিকাংশ লোক পানির নির্মম অপচয় করে থাকে।
ঢাকা ওয়াসা যে পরিমাণ পানি সরবরাহ করে, তারও একটা উল্লেখযোগ্য অংশ কিন্তু ভোক্তার কাছে পৌঁছায় না। সংস্থাটি এর বিল পায় কিনা, তার চেয়ে বড় প্রশ্ন-এ পানি উত্তোলিত হয়েছে ভূগর্ভের আরও নীচ থেকে এবং এতে খরচ হয়েছে আরও বেশি। রাজধানী ও এর আশপাশের এলাকায় ভূগর্ভস্থ পানির স্তর কত নিচে নেমে যাচ্ছে, সেটা নিয়ে সময়ে সময়ে প্রকাশিত খবরে আতঙ্কিত হতে হয়। এ অবস্থায় আশপাশের নদীর পানি পরিশোধন করেও সরবরাহ করা হচ্ছে বটে। তবে এর পরিমাণ কম; প্রত্যাশামতো বাড়ছে না এবং এক্ষেত্রে পানি উৎপাদন ও সরবরাহের খরচ আরও বেশি।
খরচ বেশি হলেও ভূউপরিস্থ পানির অধিক ব্যবহারের দিকেই আমাদের যেতে হবে। শুধু আবাসিক খাতে নয়, এমনকি সেচ কাজেও। কারণ আমরা যেভাবে নির্বিচারে পানি তুলে ব্যবহার করছি, তাতে দেশের অনেক অঞ্চলের ভূগর্ভে এবং সামগ্রিকভাবে প্রকৃতিতে একটা উদ্বেগজনক পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে। নদ-নদী, খাল-বিল, পুকুর আর ঝিরির দেশে ভূউপরিস্থ পানিও গেছে কমে। এক কথায় বললে, অভিন্ন নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা নিয়ে সুদীর্ঘ সংকট চলাকালে আমরাও স্থানীয় কর্তব্য পালনের বিপরীত আচরণ করেছি। এ অবস্থায় বৃষ্টিহীন গ্রীষ্মে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর যাচ্ছে শোচনীয়ভাবে নেমে। দেশের বেশির ভাগ অঞ্চলে এবারকার পরিস্থিতি নাকি বেশি প্রতিকূল। এ সময়ে আবার কিছুটা বৃষ্টিপাত শুরু হলেও চলমান প্রতিকূলতা কতটা কাটিয়ে ওঠা যাবে, বলা কঠিন। তাপপ্রবাহ নতুন করে শুরুর পূর্বাভাসও রয়েছে। আর সাধারণভাবে বৃষ্টিপাত কমে আসার প্রবণতাই বেশি দেখা যাচ্ছে এ অঞ্চলে। তার পরও যেটুকু বৃষ্টির পানি বছরের একটা সময়ে মেলে, তা ধরে রেখে শুষ্ক মৌসুমে ব্যবহারের বিষয়ে অনেক কথা হলেও কাজ হয়নি বললেই চলে। এরই মধ্যে তিস্তায় জলাধার তৈরির মহাপরিকল্পনায় বিনিয়োগ নিয়ে শুরু হয়েছে কথাবার্তা। এক্ষেত্রে কতদিনে কী হবে বা আদৌ কিছু হবে কিনা, তাতে কিন্তু সংশয় রয়েছে। এসব বড় বড় কাজের আশায় বসে না থেকে সবসময়ই আমাদের উচিত হবে সম্ভব সব ক্ষেত্রে পানির সুপরিকল্পিত ব্যবহারে এগিয়ে আসা।
- ট্যাগ:
- মতামত
- কৃষিকাজ
- সুপেয় পানি
- ভূগর্ভস্থ পানি