মানুষের পক্ষে কথা বলার শেষ কমরেডদের একজন তিনি
অনেকেই জেনে থাকবেন সপ্তদশ শতকে ইংরেজ মহাকবি জন মিল্টন ব্রিটিশ পার্লামেন্টের উদ্দেশে একটি লিখিত বক্তৃতা দিয়েছিলেন। এই বক্তৃতাটি পরবর্তী সময়ে বিশ্বসাহিত্যের ইতিহাসে ধ্রুপদী সাহিত্যকর্ম হিসেবে বিবেচিত হয়। এটি মূলত মতপ্রকাশের স্বাধীনতার পক্ষে তাৎপর্যপূর্ণ কথার প্রকাশ। পরে বক্তৃতাটি পুস্তিকা আকারে প্রকাশ করা হয়েছিল। এটি দুনিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে তুলনামূলক সাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ পাঠ্যসূচি হিসেবে গৃহীত। রচনাটি মূলত মতপ্রকাশের স্বাধীনতার পক্ষে নানা সূত্র ও যুক্তিপূর্ণ পদবাচ্যে সমৃদ্ধ।
এই রচনার পেছনে একটি প্রেক্ষাপট ছিল। মিল্টন বক্তৃতাটি দিয়েছিলেন ১৬৪৪ সালে। তার আগে দুটি ঘটনায় মিল্টন ক্ষুদ্ধ ছিলেন। একটি ছিল ১৬৩৮ সালের। ওই সময় কবি জন লিলবার্নেকে বিধ্বংসী বই আমদানির অভিযোগে গ্রেফতার করা হয় এবং পাঁচশ পাউন্ড জরিমানা করা হয়। পরের ঘটনাটি ১৬৪৩ সালের। ওই বছর দেশটির সংসদ ‘অনুমোদন আদেশ ১৬৪৩’ শীর্ষক একটি অধ্যাদেশ সামনে নিয়ে আসে। একই বছর বিবাহ বিচ্ছেদের পক্ষে জন মিল্টন নিজের রচনার জন্য অনুমোদন জটিলতায় ভুক্তভোগী ছিলেন। এহেন বাস্তবতায় ক্ষুদ্ধ জন মিল্টন বিরল এই বক্তৃতা দিয়েছিলেন। এই বক্তৃতাই ‘এরিওপেজিটিকা’ (Areopagitica) শিরোনামে প্রকাশিত হয়।
রনো ভাইয়ের মৃত্যুতে গল্পটি মনে পড়লেও সমসাময়িক ইতিহাসে হুবহু এরকম কোনো ঘটনা আমাদের দেশে নেই। তবে অন্য প্ৰেক্ষাপট আছে যা থেকে গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যকর্ম রচনার উদাহরণ আমাদের সামনে দেখতে পাই। দেশের বেসরকারি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে কলা, বাণিজ্য এবং বিজ্ঞানসহ সকল অনুষদের শিক্ষার্থীদের জন্যে একটি বিষয়সূচি বাধ্যতমূলক করেছে। বিষয়টির নাম ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ’। বিষয়টি পড়ানোর জন্যে এমন একজনকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে তিনি প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ইতিহাসের শিক্ষার্থী নন, তার প্রাতিষ্ঠানিক পাণ্ডিত্যপূর্ণ ডিগ্রিও নেই। তিনি ইতিহাসবিদ ছিলেন না, ইতিহাসের শিক্ষকও ছিলেন না। এমনকি তিনি ইতিহাসের ছাত্রও ছিলেন না। তিনি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৬০-এর দশকে পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্র এবং সে বিষয়েও পড়াশোনা শেষ করতে পারেননি জেলজুলুমের কারণে। পরে অবশ্য আইন বিষয়ে পড়াশোনা শেষ করেছেন।
সেই তিনি ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ’ পড়াতে এসে দেখলেন শিক্ষার্থীদের উপকারে আসে এমন তাৎপর্যপূর্ণ বইপুস্তকের বড় অভাব। তিনি নির্ধারিত কোনো বইয়ের ওপর নির্ভর না করে প্রতিটি পাঠদানের পূর্বে বিষয়ভিত্তিক নোট আকারে বক্তৃতাগুলো লেখা শুরু করলেন। বক্তৃতা শেষে শিক্ষার্থীদের লিখিত নোটগুলো তাদের মাঝে বিলিয়ে দিতেন। একপর্যায়ে সেই বক্তৃতাগুলোই ‘পলাশী থেকে যুক্তিযুদ্ধ’ শিরোনামের তিনখণ্ডের ধ্রুপদী এক সাহিত্যকর্ম হিসেবে প্রকাশিত হয়।
বইটির লেখকের নাম হায়দার আকবর খান রনো। যিনি ঢাকার রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে ‘রনো ভাই’ নাম সমধিক পরিচিত। এই রনো ভাইয়ের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে আমার চেনা পরিচয় না থাকলেও ৯০-এর দশকের শেষের দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী থাকার সময়ে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর থেকে প্রকাশিত ‘সাপ্তাহিক বিচিত্রা’য় বেবী আপার (বেবী মওদুদ) সঙ্গে কাজ করার সময়ে এবং পরে আমার স্ত্রী রাশিদা আসমার সুবাদে রনো ভাই সম্পর্কে কিছুটা জানার সুযোগ পাই। এরপর ওনার লেখালেখির প্রতি আমি আগ্রহী হয়ে উঠি।
তার লেখা পড়ে মনে হয়েছে তিনি একজন উঁচু পর্যায়ের রাজনৈতিক দার্শনিক। তার লেখালেখির পরিধি ছিল সাহিত্য, রাজনীতি, বিজ্ঞান, ইতিহাস, সমাজ এবং দর্শনকে ঘিরে। একই সঙ্গে তিনি ছিলেন সাহিত্যসমালোচকও। তিনি সাহিত্যের নিখাদ এবং পরিপূর্ণ রাজনৈতিক বিশ্লেষণ তুলে ধরতেন বস্তুনিষ্ঠতার জায়গা থেকে। আমাদের দেশের মাইকেল মধুসূদন, নজরুল, জীবনানন্দ, মানিক বন্দোপাধ্যায়, জসীম উদদীন, সুকান্ত, শওকত আলী থেকে শুরু করে বিদেশের শেক্সপিয়র, হেগেল, মার্কসসহ কত কত লেখক-দার্শনিকের রচনাবলীর আগাগোড়া যেন তার নখদর্পণে ছিল। বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে খুব উঁচু অবস্থানে থেকেও তিনি ছিলেন সাধারণ্যে মিশে থাকা অসাধারণ এক প্রতিভা। তার লেখার একটা দর্শন ছিল। ওই দর্শন ছিল মানুষের পক্ষে কথা বলা। এই অনুপ্রেরণা তিনি পেয়েছিলেন পারিবারিকভাবেই।
পিতৃভূমি নড়াইল হলেও তিনি জন্মেছিলেন কলকাতায় ১৯৪২ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ডামাডোলের মধ্যে। ওইসময় প্রকৌশলী বাবার চাকরিসূত্রে তাদের পরিবার কলকাতায় বাস করত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন ব্রিটিশ সরকারের অধীনস্থ প্রকৌশলী হিসেবে তার বাবার পদায়ন ছিল চট্টগ্রাম ফ্রন্টে। তার জন্মের সময় বাবা ছিলেন চট্টগ্রামে। পরে শৈশবে বাবার কাছে যুদ্ধের অনেক গল্প শুনেছেন, শুনেছেন যুদ্ধের পরের এবং আগের অনেক গল্প এবং গল্পের পেছনের গল্পও।
ওই সময় কলকাতার কাগজের সব খবরে থাকত ব্রিটিশরা সব জায়গায় কেবল জিতছে আর জিতছে। কিন্তু এর বিপরীতে ভারতবর্ষের মানুষ বিশেষ করে কলকাতা আর বঙ্গের মানুষ ছিল নেতাজির সুভাষ চন্দ্র বসুর গুণগ্রাহী। নেতাজি যেহেতু জাপানের পক্ষের, তাই কলকাতার মানুষের মনে ছিল নেতাজি আর বাইরে তাদের ঘিরে থাকা ব্রিটিশদের খপ্পর। তাই খবরের কাগজ বিলি করার সময় হকাররা বলতেন, ‘সিধা পড়ে উল্টো বুঝুন’। কমরেড রনো ভাই সারাজীবন তার রাজনীতি ও লেখালেখির মাধ্যমে দেশের মানুষকে সত্যের খোঁজ দেবার চেষ্টা করে গেছেন, শৈশবে বাবার কাছ থেকে শোনা ব্রিটিশদের খপ্পরকে ইঙ্গিত করা ‘সিধা পড়ুন, উল্টো বুঝুন’ কথার তাৎপর্য রক্ষা করে।
- ট্যাগ:
- মতামত
- স্মরণ
- বাম রাজনীতিক
- হায়দার আকবর রনো