কমরেড রনো চির জাগরূক থাকবেন
কমরেড হায়দার আকবর খান রনো চলে গেলেন। ১০ মে দিবাগত রাত ২টা ৫ মিনিটে তাঁর জীবনাবসান হয়েছে। তাঁর মৃত্যু সংবাদ প্রচার করতে গিয়ে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম তাঁকে প্রখ্যাত মার্ক্সবাদী তাত্ত্বিক হিসেবে পরিচয় দিয়েছেন। এটা ঠিক যে, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনে মার্ক্সসবাদী তত্ত্ব সম্পর্কে তাঁর জ্ঞানভান্ডার সম্পর্কে কোনো প্রশ্ন নেই।
মার্ক্সসবাদী দর্শন ও তত্ত্বের ওপর তাঁর বিভিন্ন বই রয়েছে। তেমনি তাঁর বই রয়েছে শিল্প-সাহিত্য-বিজ্ঞানের ওপরও। কিন্তু তাঁর মূল পরিচয় তিনি একজন রাজনীতিক, কমিউনিস্ট বিপ্লবী। স্কুলজীবন থেকে পারিবারিক আবহাওয়ায় তিনি কমিউনিস্ট আদর্শের প্রতি আকৃষ্ট হন। সেই আকর্ষণ থেকে ছাত্রাবস্থা থেকেই তিনি এ দেশের তৎকালীন কমিউনিস্ট আন্দোলন ও কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়ে পড়েন। তাঁর ছাত্র আন্দোলন, শ্রমিক আন্দোলন, জাতীয় রাজনীতির প্রতিটি ক্ষেত্রে যেমন, তেমনি তাঁর ব্যক্তিগত জীবনেও এই কমিউনিস্ট আদর্শের প্রতিফলন দেখতে পাই। তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত এই আদর্শ থেকে বিচ্যুত হননি। এ জন্য তাঁর বন্ধু বিচ্ছেদ
হয়েছে। কিন্তু যে নীতি আদর্শে তিনি বিশ্বাস করতেন, তাতে তিনি সবসময় অটল থেকেছেন।
রনো ও আমি আবাল্য বন্ধু। সেই স্কুলজীবন থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত তো বটেই, রাজনীতির ক্ষেত্রে প্রতিটি বাঁক ও মোড়ে এই সেদিন পর্যন্ত আমরা এক ছিলাম। ২০০৮-এর নির্বাচনে নির্বাচনী কৌশল নিয়ে পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়েছি। কিন্তু আমাদের যে ব্যক্তিগত বন্ধুত্ব তাতে কখনও ছেদ পড়েনি।
সেই স্কুলজীবনের কথা। ভাষা আন্দোলন-পরবর্তীকালে তখন উত্তাল সময়। সেই কিশোর বয়সেই রনো আমাকে যশোর রেলস্টেশনে নিয়ে গিয়েছিলেন কমিউনিস্ট নেতা দেখানোর জন্য। রাজশাহীর খাপড়া ওয়ার্ডে গুলিতে আহত তরুণ কমিউনিস্ট নেতা আব্দুল হক তখন যশোরের একটি আসনে মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে নির্বাচনে লড়ছেন। তাঁকে বন্দি অবস্থায় নিয়ে আসা হয়েছে। তাঁকে দেখতে রনো আমাকে নিয়ে গিয়েছিলেন। এ ছাড়া চুয়ান্নর ওই নির্বাচনে মওলানা ভাসানী, শেরেবাংলা ফজলুল হকের জনসভা শুনতে রনোর সাথী হয়েছি আমি। সেই দু’জনেই আমরা আবার সাথী হয়েছি বাষট্টির সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলনে, শিক্ষা আন্দোলনে। একসঙ্গে মিছিলে হেঁটেছি, একসঙ্গে জেল খেটেছি, এনএসএফের মার খেয়েছি। এভাবে আরও পরস্পরের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছি। কেবল বন্ধুত্বের বন্ধনেই নয়, রাজনীতির বন্ধনে,
আদর্শের বন্ধনে।
ব্যক্তি জীবনে রনো ছিলেন খুব আবেগপ্রবণ। তাঁর আবেগঘন বক্তৃতা সে সময়ের ছাত্র-তরুণদের উদ্বেলিত করত। সংবাদপত্রের পাতায় তাঁর বক্তৃতা অনেক জায়গা নিয়ে ছাপা হতো। রাজনীতির বক্তৃতার ক্ষেত্রে যেমন, বিশ্ববিদ্যালয়ে সাহিত্য-সংস্কৃতি প্রতিযোগিতাতেও তিনি সামনের সারি দখল করে রেখেছিলেন। বিশেষ করে রবীন্দ্রনাথের কবিতা আবৃত্তিতে তাঁর জুড়ি মেলা ভার ছিল।
কিন্তু ওই রনোই আবার শ্রমিক আন্দোলন করতে গিয়ে দিনের পর দিন টঙ্গীর শ্রমিক বস্তিতে দিন-রাত কাটিয়েছেন। ওই শ্রমিকদের নিয়ে হেঁটে টঙ্গী থেকে ঢাকা এসেছেন। সেই শ্রমিক মিছিল নিয়ে পুরোনো গণভবনে বঙ্গবন্ধুর দরজায় উপস্থিত হলে বঙ্গবন্ধু তাঁকে নিজের পাশে বসতে বলে বলেছিলেন, ‘তোর জন্য তো বসার জায়গা লাগে না, আমার চেয়ারেই বস’।
কেবল বঙ্গবন্ধু নন, বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনারও তাঁর জন্য অগাধ ভালোবাসা ছিল। করোনাকালে করোনাক্রান্ত হয়ে রনো ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের কেবিনে ভর্তি হলে প্রধানমন্ত্রী নিজে ফোন করে তাঁর অবস্থা জানতে চেয়েছেন। ফল পাঠিয়ে দিয়েছেন।
বস্তুত, হায়দার আকবর খান রনো ছিলেন অজাতশত্রু। তাঁর নিরহংকারী চরিত্র, সদালাপ তাঁকে সবার প্রিয় করেছিল। এ কারণেই ভিন্ন মতাদর্শ ও রাজনীতির লোকেরাও তাঁকে ভালোবাসতেন, শ্রদ্ধা করতেন।
বাংলাদেশের মানুষের জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ। এই মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবে রনোর অবদান ছিল অতুলনীয়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এ দেশের বাম কমিউনিস্টরা যখন বিভ্রান্ত, পিকিংপন্থার নামে মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে, তখন ‘কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের পূর্ববাংলা সমন্বয় কমিটি’র নেতা হিসেবে রনো ওই বামদের মধ্যে যারা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছে তাদের সংগঠিত করে গড়ে তোলেন ‘জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম সমন্বয় কমিটি’। ১৯৭০-এর ২ জুন ওই কমিটির তরফ থেকে যে ঘোষণাপত্র গ্রহণ করা হয় তার রচয়িতা ছিলেন হায়দার আকবর খান রনো।