স্ববিরোধী নীতিতে কেমন হবে বাজেট?

যুগান্তর ড. আর এম দেবনাথ প্রকাশিত: ১১ মে ২০২৪, ১১:৪৮

ত্রাণকর্তা আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ‘বুদ্ধি’ প্রখর! এর প্রমাণ সর্বসাম্প্রতিক পরামর্শ বা ‘প্রেসক্রিপশন’। এটা দেওয়া হয়েছে সাহায্যপ্রার্থী বাংলাদেশকে। তারা বলেছে, মানুষকে ‘মারতে’ হয় ধীরে ধীরে ‘মারো’। এক গুলিতে মেরো না। এতে প্রতিবাদ হয়, বিক্ষোভ হয়। মিডিয়া রুষ্ট হয়। জনমনে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। এর চেয়ে বরং ‘তিলে তিলে’ মারো। সুচতুরভাবে মারো। কেউ যাতে টের না পায়। এ বুদ্ধিতেই তারা আমাদের চাপ দিয়ে বলছে, ভর্তুকি হ্রাস করো বিদ্যুৎ থেকে, গ্যাস থেকে, তেল থেকে এবং সার থেকে। এটুকু বুঝলাম। পরেরটুকুই ‘বুদ্ধি’র কাজ। সাম্প্রতিক পরিদর্শনকালে তারা বলেছে, একবারে বাড়িও না। বিদ্যুতের দাম বছরে চারবার বাড়াও। কম করে বাড়াও। এতে মানুষ কম ব্যথা অনুভব করবে। লেখালেখি কম হবে। চাপটা ধীরে ধীরে বাড়বে। মানুষের সহ্যশক্তি তা হজম করে নেবে। এবং এর নাম কিন্তু মূল্যবৃদ্ধি হবে না। এর নাম হবে মূল্য ‘সমন্বয়’ (অ্যাডজাস্টমেন্ট)। এমনিতে সমন্বয় করতে হলে কম-বেশি করতে হয়। কিন্তু তাদের সমন্বয়ে বাস্তবে বাংলাদেশে কোনো মূল্য হ্রাসের ঘটনা বিরল। সব সময়ই বৃদ্ধি।


আরেকটা ‘বুদ্ধি’ সরকার প্রয়োগ করে। যেসব জায়গায় সুযোগ আছে, সেখানে জিনিসপত্রের দাম বাড়ায় প্রশাসনিক নির্দেশে। সাধারণভাবে বিশ্বাস করা হতো মূল্যবৃদ্ধি, কর আরোপ ইত্যাদি কাজ হবে সংসদে। সংসদে বিতর্ক হবে, আলাপ হবে, পক্ষে-বিপক্ষে কথা হবে। সিদ্ধান্ত হবে। বাস্তবে হয় ভিন্ন। তেলের দাম, বিদ্যুতের দাম, গ্যাসের দাম, ধান-চালের সংগ্রহ মূল্য, টিসিবির পণ্য বিক্রয় মূল্য-সবই হয় সরকারের প্রশাসনিক নির্দেশে। বাজেটে মোটা দাগে সরকারি রাজস্ব পদক্ষেপগুলো উপস্থাপন করা হয়। সাধারণভাবে বেশি থাকে সরকারের ‘পারফরম্যান্সের’ কথা। আর কিছু থাকে রাজস্ব পদক্ষেপ। কয়েক পাতা পরিসংখ্যান। বাজেটের যুক্তি, দর্শন, ইনপুট-আউটপুট বিশ্লেষণ, সফলতা-ব্যর্থতা ইত্যাদির আলোচনা থাকে কম। এসবের গোলমালে পড়ে সাধারণ পাঠক হয় বিভ্রান্ত-কী হলো বাজেটে? শেষ পর্যন্ত মানুষের ‘বুঝ’ হচ্ছে জিনিসপত্রের দাম। সাধারণ মানুষের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে তার জীবন-জীবিকা। কোন পণ্যের দাম বাড়ল, কোনটার কমল, কোথায় কর বসল, কোথায় বসল না ইত্যাদি।


এ দুশ্চিন্তা এবং অর্থনীতির নানা দুর্বলতার প্রেক্ষাপটেই আসছে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট। এ বাজেট উপস্থাপন করবেন নতুন অর্থমন্ত্রী। সঙ্গে আছেন নতুন অর্থ প্রতিমন্ত্রী। প্রেক্ষাপট সাবেক অর্থমন্ত্রীর পর্বতপ্রমাণ ব্যর্থতা। মূল্যস্ফীতি প্রায় ১০ শতাংশ। বিদেশি ও দেশি ঋণ ক্রমবর্ধমান। সুদের হার মারাত্মক। ডলারের বাজার অস্থির। আমদানি রয়েছে নিষেধাজ্ঞার মধ্যে। রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আশানুরূপ বাড়ছে না। ব্যাংকব্যবস্থা ক্রমেই দুর্বল হচ্ছে। ‘মার্জার’ প্রকল্পও যায়। ন্যাশনাল ব্যাংক লি. এবং ইউসিবিএলের মার্জার প্রকল্প ভণ্ডুল করে দেওয়া হয়েছে। অর্থ পাচার চলছেই, ডলার বাজারে হুন্ডিওয়ালারা তাদের আস্তানা গেড়েছে। এক টাকার কাজ দুই টাকায় করা অব্যাহত রয়েছে। জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ক্রমহ্রাসমান। মজুরি বাড়ছে না। নতুন কর্মসংস্থান সীমিত। ভূমধ্যসাগরে বিদেশযাত্রীদের মৃত্যুর মধ্যে বাংলাদেশিদের সংখ্যাধিক্য। সরকার খুঁজছে ‘সফট লোন’। এই হচ্ছে প্রেক্ষাপট। এর মধ্যে সমস্যা তিনটা। এক নম্বর সমস্যা মূল্যস্ফীতি, দুই নম্বর সমস্যা মূল্যস্ফীতি এবং তিন নম্বর সমস্যাও মূল্যস্ফীতি। সমূহ বিপদ। রাজস্ব নেই। বন্ড দিয়ে দেনা শোধ করতে হচ্ছে। বিদেশি কোম্পানিগুলো ডলারে তাদের মুনাফা দেশে পাঠাতে পারছে না। এরই মধ্যে দৈত্যের মতো এসে হাজির মূল্যস্ফীতি।


মূল্যস্ফীতিতে সমস্যা কী? সমস্যা হচ্ছে, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বলছে, তেলের দাম বাড়াও, গ্যাসের দাম বাড়াও, বিদ্যুতের দাম বাড়াও, সারের দাম বাড়াও। পরক্ষণেই বলছে, মূল্যস্ফীতি কমাতে হবে। সামাজিক নিরাপত্তা বলয়ের আওতা বাড়াতে হবে। এখানেই কি শেষ? না, তারা আরও বলছে, ডলারের দাম বাজারমুখী করতে হবে, যার সোজা অর্থ-ডলারের দাম টাকার বিপরীতে বাড়াও। মানে কী? মানে আবার মূল্যবৃদ্ধি। কারণ আমরা গম, চাল, ডাল, নুন, তেল, দুধ, মাছ, আদা-রসুন-পেঁয়াজ আমদানি করে খাই। আপেল আমদানি করে খাই। চিনি আমদানি করি। কাঁচামাল, মধ্যবর্তী পণ্য এবং শিল্পপণ্য ও যন্ত্রপাতি সবই আমদানি করি। তাহলে কী দাঁড়ায়? ৮৫-৮৬ টাকায় পণ্য আমদানি করলে পণ্যের যে ‘পড়তা’ পড়ে, ১২০ টাকায় ডলার কিনে পণ্য আনলে কি সেই পড়তা পড়বে? এসব প্রশ্নের জওয়াব নেই। বেঁধে পেটানো আর কী! পুবদিকে তাকালেও মারো, পশ্চিমদিকে তাকালেও মারো। তা না হলে এমন কথা কেউ বলে-ডলারের দাম বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি কমাও! তেল, গ্যাস, বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি হ্রাস করো! স্ববিরোধী সব কথা।


আইএমএফ এবং এর দেশীয় সুবিধাভোগী অর্থনীতিবিদরা এতদিন আমাদের শুনিয়েছেন, ডলারের দাম বাড়লে টাকার হিসাবে আমাদের দেশে বিদেশিরা বেশি পণ্য কিনতে পারবে। আগে ৮৫ টাকায় ডলার বিক্রি করে বিদেশিরা বাংলাদেশে পণ্য ক্রয় করতে পারত ৮৫ টাকার। এখন একই পরিমাণ ডলার দিয়ে পণ্য কিনতে পারবে ১২০ টাকার। এতে বিদেশি ক্রেতারা বর্ধিত পরিমাণে পণ্য কিনবে। রপ্তানি শনৈঃ শনৈঃ বাড়বে। বহুদিন ধরে একথা শুনে আসছি। কিন্তু বাস্তবতা কী? ডলারের দাম বৃদ্ধির পর কি আমাদের রপ্তানি আশানুরূপ বাড়ছে? হিসাব চাওয়া দরকার। বরং উলটো যে ডলারের পণ্য বিদেশে বিক্রি করি, সে ডলারই দেশে আসে। রপ্তানির টাকা (ডলার) প্রত্যাবাসিত হয় না। বিদেশেই থেকে যাচ্ছে ডলার। এতে টান পড়ছে আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভে। হিসাব মেলে না-বাংলাদেশ ব্যাংক বলে ১০ টাকা রপ্তানি আয় হয়েছে, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড বলে ১৫ টাকা রপ্তানি আয় হয়েছে। এসব হিসাবের ওপর ভিত্তি করেই বাজেট হচ্ছে, সরকারের হিসাব করা হচ্ছে। হিসাবে গণ্ডগোল হয়ে যাচ্ছে। জিডিপি প্রবৃদ্ধির হারের সঙ্গে রাজস্ব বৃদ্ধি, আয় বৃদ্ধি, চাকরির সংস্থান, বিনিয়োগ ইত্যাদির হিসাব মেলে না। এ অবস্থাতেই আসছে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট।

সম্পূর্ণ আর্টিকেলটি পড়ুন

প্রতিদিন ৩৫০০+ সংবাদ পড়ুন প্রিয়-তে

এই সম্পর্কিত

আরও