প্রযুক্তির ব্যবহার আমাদের কোথায় নিয়ে যাবে
বছরখানেক আগে একটা সেমিনারে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। সেখানে অনেকের সঙ্গে আরও দুই-তিনজন ব্যক্তি উপস্থিত ছিলেন, যাঁরা আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে কাজ করেন। তাঁরা যখন তাঁদের গবেষণাকাজের কথা বলছিলেন, তখন মনে হলো তাঁরা যেন বিজ্ঞানের মর্মার্থ বোঝানোর চেয়ে পণ্য উৎপাদনের বিষয়ে বেশি বললেন। মানুষের কিসে সুবিধা হবে, কিসে লাভ হবে—তার হিসাব দেখানোয় বেশি মনোযোগ দিলেন। আমি হতবাক হলাম এই ভেবে, বিজ্ঞানের আলোচনা কেমন করে যে বাণিজ্যিক আলোচনায় রূপ নিচ্ছে। এটাই কি আমাদের কাম্য বা লক্ষ্য ছিল?
আমি প্রশ্ন না করে পারলাম না। গবেষণার উদ্দেশ্য কি শুধু সুবিধা দেওয়া, বিজ্ঞানকে আত্তীকরণ করা নয়?
এই প্রাযুক্তিক সুবিধা ২৫ বছরে যে পরিমাণ দেওয়া হয়েছে, তা বিগত ৩০০ বছরে মানুষ চিন্তায়ও আনতে পারেনি। গড়ে ছয় ইঞ্চি বাই আড়াই ইঞ্চি আকৃতির মোবাইল ফোন নামে ছোট্ট যন্ত্রটি সুবিধার এক মহাসাগরে রূপ নিয়েছে। এর মধ্যে আমরা সবাই হাবুডুবু খাচ্ছি। আমাদের মধ্যকার সাংস্কৃতিক পার্থক্য বেড়েই চলেছে। পরিণামে আমরা একটি ‘কালচারাল ব্যাটল ফিল্ড’ বা সাংস্কৃতিক সংঘাতের মধ্যে প্রবেশ করেছি। যেটাকে বিজ্ঞানী ও চিন্তাবিদেরা সবচেয়ে বড় বিপদ বলে অভিহিত করেছেন। এমনকি এটাকে সভ্যতার ষষ্ঠ গণবিলুপ্তি বলা যেতে পারে।
এরই প্রতিফলন পর্যবেক্ষণ করার সুযোগ হয়েছিল এ বছরের ১২ ফেব্রুয়ারি ইউএসএ সিনেটে টেক জায়ান্টদের উপস্থিতির ঘটনাটিতে। সেখানে ৪ ঘণ্টা ধরে সিনেটররা টেক জায়ান্টদের জেরা করেছেন। প্রযুক্তির এই কর্তাদের সামনে থেকে জেরা করার সুযোগ পাওয়া যে-সে ব্যাপার নয়। পরিস্থিতি কতটুকু বিপন্ন অবস্থায় পড়লে এ রকম হয়? সেই আলোচনা সভায় বিশ্বের নামকরা প্রযুক্তি কোম্পানির কর্তাদের উপস্থিতিতে বলা হয়েছিল, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোর অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহারে এই প্রজন্ম ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, স্বয়ং মেটার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মার্ক জাকারবার্গ ক্ষমাও চেয়েছেন। ইনস্টাগ্রাম ও ফেসবুকের জাকারবার্গ সিনেটে উপস্থিত অভিভাবকদের দিকে তাকিয়ে বলেছেন, এমন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে কারও যাওয়া উচিত না।
উল্লেখ্য, সেই আলোচনায় জাকারবার্গ এবং টিকটকের সিইও শাও জি চিউ স্বেচ্ছায় সাক্ষ্য দিতে রাজি হলেও স্ন্যাপ, এক্স (আগের টুইটার) এবং ডিসকর্ডের প্রধানেরা প্রাথমিকভাবে তা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। এরপর সরকারের সমন জারির মাধ্যমে তাঁদের সেখানে আসতে বাধ্য করা হয়। সিনেটে উপস্থিত হওয়া পাঁচ প্রযুক্তি কোম্পানির প্রধানের পেছনে বসে থাকা অভিভাবকদের চাপেই তাঁরা এখানে এসেছেন। তাঁদের পরিবারে সন্তানেরা বিভিন্নভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় এ উদ্যোগ। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কনটেন্টের কারণে তাঁদের সন্তানেরা যৌন হয়রানি, প্রতারণার শিকার হওয়া থেকে আরম্ভ করে আত্মহত্যা পর্যন্ত করেছে। প্রযুক্তির কর্তারা যখন সিনেট কক্ষে প্রবেশ করেন, তখন ওই পরিবারগুলোকে তাঁদের প্রতি ঘৃণা প্রকাশ করতে দেখা গিয়েছিল।
ওই শুনানিতে অনলাইনে নির্যাতন থেকে শিশুদের রক্ষা করার বিষয়টিই একমাত্র লক্ষ্য হওয়া উচিত ছিল। তবে এটা দুঃখজনক, এর বাইরে সিনেটররা এমন সব প্রশ্ন করেন, তাতে মূল বিষয়টি অনেকখানি ফিকে হয়ে যায়। যেমন বাইটডান্স নামের একটি চীনা কোম্পানির মালিকানাধীন টিকটকের সিইও শাও জি চিউকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, তাঁর প্রতিষ্ঠান আমেরিকান ব্যবহারকারীদের তথ্য চীন সরকারকে দেয় কি না। উত্তরে তিনি সিঙ্গাপুরের নাগরিক জানালেও ইউএস সিনেটর টম কটন চিউকে জিজ্ঞেস করেন, তিনি চীনা কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে কখনো যুক্ত ছিলেন কি না। এটা থেকে বোঝা যায়, বৈশ্বিক নেতৃত্বদানকারী সমাজের প্রতিনিধিরা বুঝে উঠতে পারছেন না বা চাইছেন না বিপদটার মাত্রা; বুঝলে অপ্রাসঙ্গিক বিষয় নিয়ে কথা বলে সময় নষ্ট করতেন না। তবে শাও জি চিউ বলেছেন, ‘তিনটি ছোট সন্তানের বাবা হিসেবে আমি বুঝতে পারছি যে আমরা আজ যে বিষয়টি নিয়ে এখানে আলোচনা করছি, তা ভয়ংকর এবং অনেক মা-বাবার জন্য দুঃস্বপ্নের মতো।’