অশান্ত পাহাড় : এখন যা করা দরকার
বান্দরবানের থানচি ও রুমায় কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের (কেএনএফ) সাম্প্রতিক হামলার জেরে বেশ কয়েকজনকে গ্রেফতার করেছে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)। বলা হচ্ছে, গ্রেফতার ব্যক্তিদের একজন দলটির কেন্দ্রীয় কমিটির ‘অন্যতম প্রধান সমন্বয়ক’, নাম চেওসিম বম। মিডিয়ায় আটক ব্যক্তিদের দেখানোও হচ্ছে। এ ধরনের প্রচার কিন্তু আমাদের জন্য ইতিবাচক নাও হতে পারে। ভুলে গেলে চলবে না, আটক হওয়া ব্যক্তিদের বমসহ নৃ-জাতিগোষ্ঠীতে জনপ্রিয়তাও থাকতে পারে। ফলে মিডিয়ায় তাদের হাতকড়া পরা দৃশ্য উলটো পার্বত্য এলাকায় নৃ-গোষ্ঠীর মধ্যে উত্তেজনার সৃষ্টি করতে পারে। এতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযান আরও কঠিন হয়ে যেতে পারে।
কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট বা কেএনএফ নামের সশস্ত্র গোষ্ঠীটি প্রায় তিন বছর ধরে বান্দরবানের থানচি, রুমা, আলীকদমসহ বিভিন্ন এলাকায় সক্রিয় আছে। সম্প্রতি এ গোষ্ঠীটি অল্প সময়ের মধ্যে থানচি, রুমা ও আলীকদমে হামলা চালিয়ে আলোচনায় এসেছে। সেখানকার বম, পাংখোয়া, লুসাই, খিয়াং, ম্রো ও খুমি-এসব জাতিগোষ্ঠীর মানুষ নিয়ে সংগঠনটি গঠিত হয়েছে। জাতিগোষ্ঠীগুলোর বেশির ভাগ খ্রিষ্টধর্মের অনুসারী। প্রথমদিকে তাদের বক্তব্য ছিল, পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রধান জাতিগোষ্ঠী চাকমা ও মারমাদের দ্বারা তারা নিগৃহীত হচ্ছেন। এ কারণে এ দুই জাতিগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে তারা অস্ত্র তুলে নিয়েছেন। এ প্রেক্ষাপটটা মূলত তৈরি হয়েছে ১৯৯৮ সালের পার্বত্য শান্তিচুক্তির পর। পার্বত্য চুক্তির ফলে যেসব সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টি হয়েছে, তার বেশির ভাগই রাঙামাটি ও খাগড়াছড়িকেন্দ্রিক এবং সুবিধাভোগীদের বেশির ভাগ ছিল চাকমা, এরপর মারমা। এখানে যে বঞ্চনা বা বৈষম্য তৈরি হয়েছে, কুকি-চিনদের ভাষ্য হলো, সে কারণে তারা অস্ত্র ধরেছে। কেএনএফকে যিনি নেতৃত্ব দিচ্ছেন, নাথান বম, তিনি কিন্তু বান্দারবানের রুমার ছেলে। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটে পড়াশোনা করলেও এখন সশস্ত্র পথে ঢুকেছেন।
বঞ্চনা বা বৈষম্য থেকে মুক্তির কথা বললেও কেএনএফ কিন্তু ধীরে ধীরে তাদের চরিত্র বদলেছে, হয়ে উঠেছে আরও দুর্ধর্ষ। দেখা গেল, অর্থের জন্য তারা ইসলামি তথাকথিত জঙ্গিগোষ্ঠীকে প্রশিক্ষণ দেয়, হয়তো সেই অর্থ দিয়ে তারা আরও বেশি অস্ত্র কিনেছে। এরপর সেখানে জঙ্গিগোষ্ঠীকে দমনের পর কুকি-চিনের সঙ্গেও শান্তি আলোচনার উদ্যোগ নেওয়া হয়। তবে তাদের দিক থেকে শান্তি আলোচনার বিষয়টি হচ্ছে পুরোনো খেলা। গোটা পার্বত্য চট্টগ্রাম যখন পুরোপুরি সশস্ত্র পরিস্থিতিতে ছিল, তখনও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সঙ্গে এরকম শান্তি আলোচনা বহুবার হয়েছিল। দেখা গেছে, শান্তি আলোচনার মাধ্যমে সশস্ত্রগোষ্ঠী আরও শক্তি সঞ্চয় করে। কাজেই এ ধরনের গোষ্ঠীর সঙ্গে শান্তি আলোচনার মানে হলো তাদের আপনি স্বীকৃতি দিলেন। তারা তখন আরও লোকবল রিক্রুট করার সুযোগ পায় ও প্রচার চালায়। দেখায় যে, সরকার তাদের গুরুত্ব দিচ্ছে, তাদের সঙ্গে দরকষাকষি করছে। আরও তরুণ ছেলে তখন তাদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায়। একটি সশস্ত্র সংগঠন যেভাবে বেড়ে ওঠে, কেএনএফও সেভাবেই নিজেদের শক্তি বৃদ্ধি করেছে।
পাহাড় ও সাঙ্গু নদ দিয়ে বেষ্টিত রুমা শহর, যেটি মূলত রুমা বাজার নামে পরিচিত, সেটি একটু নিচের দিকে অবস্থিত, অনেকটা উপত্যকার মতো। সেনাবাহিনীতে থাকাকালে একসময় এলাকাগুলোয় আমি দায়িত্ব পালন করেছি। আমি সেখানে রিজিওনাল এবং ব্রিগেড কমান্ডার ছিলাম। আমি দায়িত্বরত অবস্থায় সরাসরি সেখানে যাওয়া যেত না। যেতে হলে একপাশে নদী অতিক্রম করে যেতে হতো। অন্যপাশে পাহাড় থেকে নেমে যেতে হতো, সেখানে ছিল ক্যান্টনমেন্ট। এখন যোগাযোগব্যবস্থা অনেক উন্নত হয়েছে, নদের ওপর সেতু হয়েছে। সরাসরি গাড়িতে করে রুমা বাজারে চলে যাওয়া যায়। এখন নিঃসন্দেহে রুমায় জনসংখ্যা বেড়েছে। আর পার্বত্য চুক্তির পর সেনাবাহিনীকে অনেক জায়গা থেকে তুলে নেওয়া হয়, তাদের অবস্থান হয় কয়েকটি নির্ধারিত ক্যান্টনমেন্টে। যেমন রুমা, আলীকদম ও বান্দরবানে রয়েছে।