চট্টগ্রামে ‘গাছ কাটা উন্নয়ন’ কেন বারবার?
‘আবারো’ শব্দটিকে নিদারুণভাবে ভয়াবহ করে তোলা হচ্ছে। শব্দটি শুনলেই যেন সামনে হাজির হয় সহস্র অমীমাংসিত হাহাকার। প্রতিদিন ক্ষুব্ধ, ক্রুদ্ধ, দগ্ধ, বেদনার্ত হয়ে লিখতে হয় ‘আবারো’। ‘আবারো বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্ষণ’, ‘আবারো আগুনে অঙ্গার’, ‘আবারো ফসলের বিষে মরল পাখি’, ‘আবারো পাহাড় কাটা’ কিংবা ‘আবারো উন্নয়নের করাতে প্রাণ গেল গাছের’।
এর বাইরে ‘আবারো’ শব্দটি কোনো আশা জাগানিয়া স্বপ্নময়তার সাহস নিয়ে পালক মেলে না আজকাল। ২১ মার্চ বিশ্ব বনদিবসের আওয়াজ মেলাতে না মেলাতেই খবর এল এক্সপ্রেসওয়ের স্থাপনা নির্মাণের জন্য এখন গাছ কাটতে চায় ‘চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (চউক)’। প্রতিষ্ঠানটি সংক্ষেপে সিডিএ (চট্টগ্রাম ডেভলপমেন্ট অথরিটি) নামে পরিচিত হওয়ায় চলতি লেখায় সিডিএ নামটি ব্যবহৃত হচ্ছে।
একটা এক্সপ্রেসওয়ে বানাতে যখন প্রবীণ বৃক্ষদের মেরে ফেলার সিদ্ধান্ত নেয় কোনো সরকারি কর্তৃপক্ষ, তখন বাধ্য হয়ে বলতেই হয় ‘আবারো’। আবারো উন্নয়নের প্রশ্নহীন কোপ পড়তে যাচ্ছে গাছের শরীরেই। বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা পাবলিক পরিসর সর্বত্র আমরা দেখছি নতুন ভবন নির্মাণ এবং অবকাঠামোগত উন্নয়নের কারণে প্রথম খুন হয় সেখানকার গাছপালা, তরুলতা, গুল্ম। উন্নয়নের বিজ্ঞাপনকে সামনে রেখে এলোপাথারি জখম হয় গাছ।
সিডিএ চট্টগ্রামের লালখান বাজার থেকে পতেঙ্গা পর্যন্ত এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ করছে। ২০১৯ সালে প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। প্রধানমন্ত্রী ১৬ কিলোমিটার দীর্ঘ এই উন্নয়ন প্রকল্প উদ্বোধন করেন। প্রায় ৪ হাজার ২৯৮ কোটি টাকা ব্যয়ের এই এক্সপ্রেসওয়েতে গাড়ি ওঠানামার জন্য প্রায় ১৪টি র্যাম্প রাখা হয়েছে। এর ভেতর দুটি নগরের সবুজবলয় টাইগারপাসে। টাইগারপাস থেকে পলোগ্রাউন্ড পর্যন্ত মোহাম্মদ ইউসুফ চৌধুরী সড়কে গাড়ি ওঠার জন্য একটি র্যাম্প হবে এবং নিচে আরেকটি। এছাড়া একটি জিইসি মোড়ে, চারটি আগ্রাবাদে, একটি ফকিরহাটে, দুটি নিমতলায়, দুটি সিইপিজেডে এবং দুটি কেইপিজেডে। গাড়ি ওঠানামার এই র্যাম্প তৈরি করতে হলে কাটতে হবে চট্টগ্রামের এই গুরুত্বপূর্ণ সবুজবলয়ের বহু গাছগাছালি। বিনষ্ট হবে এই বাস্তুতন্ত্র। বহু বুনোপ্রাণ হারাবে বাসস্থান ও বিচরণস্থল।
ইতোমধ্যেই প্রায় ৫০টি গাছের শরীরে লালকালির মৃত্যুদণ্ড আঁকা হয়েছে। গাছকাটা বিষয়ে সিডিএ প্রধান প্রকৌশলী গণমাধ্যমকে জানান, উন্নয়ন কাজ করতে গেলে কিছু গাছ কাটা পড়ে। তিনি আরো জানান, আউটার রিং রোডে ২০ হাজার গাছ কাটা পড়েছিল কিন্তু পরে লাগানো হয়েছে ৫ লাখ। গণমাধ্যমসূত্রে জানা যায়, জমি ব্যবহারের জন্য রেলের অনুমতির পাশাপাশি বনবিভাগের কাছে গাছ কাটার অনুমতিও চেয়েছে সিডিএ। আশা করি রাষ্ট্র পরিবেশবাদী, গবেষক, পেশাজীবীসহ নাগরিক সমাজের প্রতিক্রিয়াকে গুরুত্ব দেবে। ব্রিটিশ উপনিবেশ বিরোধী আন্দোলনের স্মৃতিবহ চট্টগ্রামের উল্লিখিত সবুজবলয়ের গাছ কাটা বন্ধ রাখবে। গাছ না কেটে এক্সপ্রেসওয়ে ও উন্নয়নকাজ সমাপ্ত করবে।
কীভাবে করবে? সর্বজনের মতামত ও অংশগ্রহণের ভিত্তিতে। প্রকৌশলী, নগর পরিকল্পনাবিদ, রাজনৈতিক, পরিবেশকর্মী এবং নগরবাসীদের গাছ বাঁচিয়ে রাস্তা ও র্যাম্প বানানোর পরিকল্পনা করতে হবে। নতুন চিন্তা, নতুন উদ্ভাবনকে গুরুত্ব দিতে হবে। বৃক্ষবান্ধব অবকাঠামোগত উন্নয়নচিন্তা ও নগরপরিকল্পনাকে সক্রিয় করতে হবে। ‘সম্মিলিত পরিবেশ রক্ষা আন্দোলনের’ ব্যানারে গাছ জড়িয়ে ধরে প্রতিবাদ প্রতিরোধ গড়ে তুলছেন চট্টগ্রামের নাগরিক সমাজ। গাছের জীবন বাঁচাতে চট্টগ্রামের নাগরিক আন্দোলনের সঙ্গে সংহতি জানিয়ে গাছ কাটার সিদ্ধান্ত বাতিল করে দ্রুত চট্টগ্রাম নগরীর সবুজবলয়ের নিরাপত্তা সুরক্ষার দাবি জানাই।