আত্মহত্যা: আমাদের বিপন্নতা ও পারস্পরিক দায়বদ্ধতা
গত এক সপ্তাহে ছয়টি আত্মহত্যার খবর দেখলাম। ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তায় একটি পরিবারের সদস্যদের সম্মিলিত আত্মহত্যা, এরপর উত্তরার কামারপাড়ায় মৌসুমি ও ইব্রাহীম নামক দুজন, চট্টগ্রামে সীতাকুণ্ডের এক ছাত্রলীগ নেতা, সংগীতশিল্পী সাদি মহম্মদ, সর্বশেষ ফাইরুজ সাদাফ অবন্তিকার ফেইসবুকে পোস্ট দিয়ে আত্মহত্যা। এর আগে ২৫ ফেব্রুয়ারি ওয়াশিংটন ডিসিতে ইসরায়েলি দূতাবাসের সামনে মার্কিন বিমান বাহিনীর সদস্য অ্যারন বুশনেলের নিজের গায়ে আগুন লাগিয়ে আত্মহত্যার ঘটনা সারা বিশ্বে আলোচনায় এসেছে। আরও ঘটনা নিশ্চয়ই ঘটেছে, যেগুলো আমার চোখ এড়িয়ে গেছে। তবে যা জেনেছি, তাতেই আমার মনে হয়েছে অনেক। এত অল্প সময়ে এতগুলো মানুষের আত্মহত্যার ঘটনায় বিচলিত হয়ে জানার চেষ্টা করি বাংলাদেশে আত্মহত্যা নিয়ে কোনো সমীক্ষা আছে কিনা।
জানতে পারি, বাংলাদেশে সব মিলিয়ে কত মানুষ আত্মহত্যা করে তার কোনো পূর্ণাঙ্গ পরিসংখ্যান নেই। কিন্তু আমরা প্রায়শ আত্মহত্যার ঘটনা শুনছি, জানছি। বিশেষ করে প্রতি বছর এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফলের পর ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে আত্মহত্যার অনেক ঘটনা ঘটে।
বাংলাদেশ আইন দণ্ডবিধি ৩০৯ ধারা অনুযায়ী, আত্মহত্যার চেষ্টা ফৌজদারি অপরাধ যার শাস্তিস্বরূপ এক বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ড হতে পারে। পক্ষান্তরে, কেউ যদি কাউকে আত্মহত্যায় প্ররোচনা বা উস্কানি দেয়, বা আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দেয়, তাহলে ওই ব্যক্তিকে দশ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ড ভোগ করতে হবে। কিন্তু একটা সমাজ যদি এমন একটা রূপ নেয় যেখানে প্রত্যেকেই একে অপরকে আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দিচ্ছে, সেখানে প্ররোচক হিসাবে কাকে চিহ্নিত করা হবে?
শুরুতে উল্লেখিত আত্মহত্যার ঘটনাগুলো প্রত্যেকটি ভিন্ন, কিন্তু আত্মহত্যা একটি সামাজিক বিষয়। আত্মহত্যাকে একক পদক্ষেপ হিসাবে ভাবার কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। এটি আত্মহননকারীর সিদ্ধান্তকে নৈতিকতার দোহাই দিয়ে মহিমান্বিত করার সুযোগ তৈরি করে।
এ ব্যাপারে এমিল ডুর্খেইম আত্মহত্যার সামাজিক ব্যাখ্যা দেন। ডুর্খেইমের বক্তব্যটি আমি যেভাবে বুঝেছি— নীতি, সততা কোনো ব্যক্তিগত বিষয় নয় বরং এগুলো একটা সমাজে বসবাসকারী ব্যক্তিদের মধ্যকার পারস্পরিক আচরণবিধি। সমাজে বসবাসকারী ব্যক্তিদের মধ্যে একে অপরের সঙ্গে কীভাবে যুক্ততা তৈরি হয় সে প্রসঙ্গে ডুর্খেইম সংহতির কথা বলেন। তিনি দেখান কীভাবে একটা সমাজে সংহতি নির্মিত হয় ও কাজ করে। তিনি দুই ধরনের সংহতির কথা বলেন।
অনাধুনিক সমাজেবিশেষ করে যেসকল সমাজে মানুষের গতিশীলতা এতটা বিস্তৃত নয়, একই স্থানে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের বসবাস, সেখানকার মানুষের মধ্যে এক ধরনের সাদৃশ্য কাজ করে। একই ধর্ম, একই জীবন যাপনের ধরন, একই মূল্যবোধ, একই অভিজ্ঞতা, একইরকম পছন্দ-অপছন্দ। এসবের মধ্য দিয়ে ওই সমাজের লোকজনের মধ্যকার পারস্পরিক বন্ধন দৃঢ় হয়, যাকে ডুর্খেইম বলেন কালেক্টিভ কনশাসনেস বা সামষ্টিক চেতনা। উদাহরণস্বরূপ, ধর্ম এরকমই একটি প্রভাবক, যা ওই অঞ্চলের ওই ধর্মের মানুষের মধ্যে এক ধরনের সামষ্টিক চেতনা তৈরি করে। এই সামষ্টিক চেতনা দ্বারা ওই সমাজের ব্যক্তিদের মধ্যে সংহতি গড়ে ওঠে যাকে ডুর্খেইম নাম দেন যান্ত্রিক সংহতি (Mechanical Solidarity)।
- ট্যাগ:
- মতামত
- শিক্ষার্থীর আত্মহত্যা