পেট্রোবাংলার সাফল্য কামনা করি
দীর্ঘ দুই দশকের বেশি সময় ধরে দেশে যে জ্বালানি-সংকট চলে এসেছে, এর একটি টেকসই সমাধানের লক্ষ্যে কাজ শুরু করেছে পেট্রোবাংলা। শুরু করেছে না বলে বলা ভালো কাজ এগিয়ে নিচ্ছে। কারণ কাজটা তারা আরও আগেই শুরু করেছিল। তাতে কিছু সাফল্যও ইতিমধ্যে অর্জিত হয়েছে। অনাকাঙ্ক্ষিত কোনো হস্তক্ষেপের ঘটনা না ঘটলে পূর্ণ সাফল্য লাভের পরিস্থিতি বিদ্যমান রয়েছে। সুতরাং এই কাজে আমরা পেট্রোবাংলার সাফল্য কামনা করতেই পারি। করাটা উচিতও।
কিন্তু কাজটা কী, সেটা পরিষ্কারভাবে সবার জানা দরকার। কাজটা হলো, দেশের নিজস্ব জ্বালানি সম্পদের অনুসন্ধান ও আহরণ বৃদ্ধি করা। এর মধ্যে প্রথম এবং প্রধান হলো প্রাকৃতিক গ্যাস। প্রাকৃতিক গ্যাসের অনুসন্ধান ও উত্তোলন বাড়ানোর লক্ষ্যে আগামী পাঁচ বছরে ১০০টি কূপ খননের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের কাজ শুরু করেছে পেট্রোবাংলা। পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান জনেন্দ্র নাথ সরকার বলেছেন, প্রাকৃতিক গ্যাসের ক্রমবর্ধমান চাহিদা শুধু দেশের গ্যাস দিয়ে পূরণ করা সম্ভব নয়। তাই এলএনজি আমাদের আমদানি করতে হবে। এমনকি ক্রমান্বয়ে এলএনজির আমদানি বাড়াতেও হবে। কিন্তু চাহিদার বৃহদাংশ সরবরাহ করতে হবে দেশের নিজস্ব গ্যাস উত্তোলন বাড়িয়ে। না হলে, আমদানি করা গ্যাসের ব্যবহার বাড়তে থাকলে তার যে দাম পড়বে, তা বহন করা আমাদের পক্ষে সম্ভব হবে না। তেমন দামে গ্যাস ব্যবহার করে দেশের কোনো শিল্প-বাণিজ্যই টিকে থাকতে পারবে না। ৬ মার্চ পেট্রোসেন্টারে আয়োজিত এক গণশুনানিতে পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান এসব কথা বলেন। বিভিন্ন শ্রেণির গ্রাহকদের অভিযোগ শোনা ও তাঁদের কাছে জবাবদিহি করার জন্য ওই শুনানির আয়োজন করা হয়েছিল।
পেট্রোবাংলা ও এর চেয়ারম্যানকে এ জন্য অবশই আমরা ধন্যবাদ জানাব যে অনেক দেরিতে হলেও একটি কঠিন সত্য তাঁরা অনুধাবন করেছেন। দেশে এমন কোনো বিশেষজ্ঞ, গবেষক ও গণমাধ্যমকর্মী খুঁজে পাওয়া যাবে না যাঁরা এ সত্যটি এক দশক ধরে বারবার বলেননি। সরকারের মধ্যেও অনেকে একই মত পোষণ করতেন। কিন্তু নীতিনির্ধারকদের মূল প্রবণতা ছিল আমদানিতে গুরুত্ব দেওয়া। এ কারণে একপর্যায়ে জ্বালানি খাতকে আমদানিনির্ভর করে এমন ঝুঁকির মধ্যে ফেলত, যেখান থেকে উঠে আসা প্রায় অসম্ভব ব্যাপার হতো। গ্যাসসংকটের কারণ হিসেবে এখন যেমন বলা হচ্ছে, গত দুই বছরে ১২ বিলিয়ন ডলার খরচ হয়েছে এলএনজি আমদানি করতে। মনে রাখা দরকার যে এখন পর্যন্ত আমাদের এলএনজি আমদানির অবকাঠামোগত সর্বোচ্চ ক্ষমতা দৈনিক এক হাজার মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের সমপরিমাণ। কিন্তু এক হাজার মিলিয়ন ঘনফুট আনা হয়েছে খুব কম দিনই। তাতেই যদি এই অবস্থা হয়, তাহলে এলএনজি আমদানি দৈনিক তিন হাজার মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের সমপরিমাণ হলে কী অবস্থা হবে?
অবশ্য এলএনজি আমদানিতে মাত্রাতিরিক্ত ব্যয়ের কারণ হিসেবে কোভিড-১৯-পরবর্তী বিশ্বে জ্বালানির চাহিদা বৃদ্ধি এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ পরিস্থিতিকে দায়ী করা হয়।
এটা যেমন মিথ্যা নয়, তেমনি এ কথাও সত্য যে বিশ্ববাজারে জ্বালানির দাম যেকোনো সময় নানা কারণে বেড়ে যেতে পারে। কাজেই জ্বালানিতে আমদানিনির্ভর হওয়া সব সময়ই ঝুঁকিপূর্ণ। আমরা একটি বিষয় ভেবে দেখতে পারি, কোভিড-১৯-পরবর্তী বিশ্বে জ্বালানির চাহিদা বৃদ্ধি এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ পরিস্থিতির কথা বলা হয়, এই পরিস্থিতি সৃষ্টির সময় যদি আমাদের হাতে আরও এক হাজার মিলিয়ন ঘনফুট বেশি দেশীয় গ্যাস উত্তোলনের সমক্ষতা থাকত, তাহলে তো আমাদের জ্বালানির কোনো সমস্যাই হতো না। বড় কথা হলো, এক হাজার মিলিয়ন ঘনফুট বেশি দেশীয় গ্যাস উত্তোলনের সক্ষমতা আমরা সহজেই অর্জন করে রাখতে পারতাম যদি আগেভাগে সেই উদ্যোগ নেওয়া হতো। এমনকি ২০১৮ সালে যখন এলএনজি আমদানি শুরু করা হয়, তখন দেশীয় গ্যাস উত্তোলন বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হলে ২০২২ সালে আমরা একটা নিরাপদ জ্বালানি পরিস্থিতিতে থাকতে সক্ষম হতাম। কিন্তু তা না করে দেশের জ্বালানি পরিস্থিতিকে সংকটের মধ্যে ফেলে দেওয়া হয়েছে। এখন পেট্রোবাংলা সেই উদ্যোগ নিয়ে কাজ শুরু করেছে।
- ট্যাগ:
- মতামত
- জ্বালানি সংকট
- পেট্রোবাংলা