সাংবিধানিক আইনের আলোকে বিশ্লেষণ
চিকিৎসায় অসদাচরণ বা অবহেলার অভিযোগ-সংক্রান্ত সাম্প্রতিক তিনটি ঘটনা সাধারণ জনমনে আবারো আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। রাজধানী ঢাকার ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঁচ বছরের শিশু আয়ানকে ফুল অ্যানেস্থেসিয়া প্রয়োগ করে খতনা করানো হচ্ছিল। অজ্ঞান অবস্থার পরিবর্তন না হওয়ায় গুলশানে ইউনাইটেড হাসপাতালের পিওআইসিতে আনা হয়। সেখানে তাকে সাতদিন পর মৃত ঘোষণা করে। এ ঘটনার কিছুদিনের মধ্যেই গত ২০ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর মালিবাগে অবস্থিত জেএস ডায়াগনস্টিক অ্যান্ড মেডিকেল চেকআপ সেন্টারে ফুল অ্যানেস্থেসিয়া প্রয়োগ করে খতনা করানোর সময় আহনাফ নামে মতিঝিল আইডিয়াল স্কুলের চতুর্থ শ্রেণীর এক ছাত্রের মৃত্যু ঘটে। অন্যদিকে রাজধানীর ল্যাবএইড হাসপাতালে এন্ডোস্কো পি করাতে গিয়ে রাহিব রেজা নামে ৩১ বছরের এক যুবকের মৃত্যু হয়েছে। অভিযোগ উঠেছে যে রাহিবকে শারীরিক অন্যান্য জটিলতা-সংক্রান্ত পরীক্ষার রিপোর্ট না দেখেই অ্যানেস্থেসিয়া প্রয়োগ করা হয়। এ তিন মৃত্যুর ঘটনা চিকিৎসা ব্যবস্থার অনিয়ম-অবহেলার দিকগুলো আবার সামনে তুলে এনেছে। চিকিৎসায় অবহেলা বিভিন্ন কারণে হয়ে থাকে। একজন ডাক্তারের যেমন দায়িত্ব আছে তেমনি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষেরও দায়িত্ব থাকে যথাযথ সাপোর্ট বা সহযোগিতা দেয়া। দুপক্ষের যথাযথ দায়িত্ব পালনের মাধ্যমেই রোগীর সঠিক চিকিৎসা নিশ্চিত হয়। চিকিৎসায় অবহেলার কোনো অভিযোগ এলে বাংলাদেশের আইনি কাঠামোয় সেটি কোন কোন আইনে ভুক্তভোগীকে প্রতিকার দিতে পারে তার বিশদ আলোচনা সেভাবে হয়নি।
পাশ্চাত্য চিকিৎসার জনক হিসেবে উল্লেখ করা হিপোক্রেটিস বলেছেন, যখনই একজন ডাক্তার ভালো করতে পারেন না, তখন তাকে অবশ্যই ক্ষতি করা থেকে বিরত থাকতে হবে। জেনেভায় ১৯৪৮ সালের ওয়ার্ল্ড মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের ঘোষণা অনুসারে, রোগীর স্বাস্থ্য একজন ডাক্তারের প্রথম বিবেচ্য বিষয় এবং এটি প্রতিটি চিকিৎসা পেশাদারকে আন্তরিকভাবে অঙ্গীকার করতে হয়। হৃদরোগ ও ক্যান্সারের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি বছর কমপক্ষে ২ লাখ ৫০ হাজার রোগী মারা যাওয়ার সঙ্গে চিকিৎসার ত্রুটি তৃতীয় প্রধান কারণ হিসেবে বিভিন্ন গবেষণায় উঠে এসেছে। বাংলাদেশে আইন ও সালিশ কেন্দ্রের একটি প্রতিবেদন অনুসারে, ১৯৯৫ সালের জুন থেকে সেপ্টেম্বর ২০০৮ পর্যন্ত চিকিৎসা সংক্রান্ত ৫০৪টি ঘটনা তালিকাভুক্ত করা হয়েছে।
মেডিকেল অসদাচরণ বা অবহেলা বলতে বোঝায় যখন চিকিৎসা বা স্বাস্থ্যসেবায় নিযুক্ত পেশাদাররা তাদের তত্ত্বাবধানে থাকা রোগীদের প্রতি দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয় এবং এর ফলে রোগী শারীরিক, মানসিক বা আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়। অনেক ক্ষেত্রে রোগীর মৃত্যুও হয়। চিকিৎসা-সংক্রান্ত অবহেলার দাবি বজায় রাখতে যে শর্তগুলো অবশ্যই পূরণ করতে হবে তা হচ্ছে স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী চিকিৎসক বা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের নির্দিষ্ট দায়িত্ব থাকা, ওই দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতা, ব্যর্থতার ফলে রোগীর ক্ষতি হয়, ওই ক্ষতি কেবল নির্দিষ্ট দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার ফলেই হয় এবং সবশেষে ক্ষতি বা আঘাত আইনতভাবে স্বীকৃত কোনো বিধানকে লঙ্ঘন করে। বিভিন্নভাবে রোগীর ক্ষতি হতে পারে। যেমন ভারতের জাতীয় ভোক্তা বিরোধ নিষ্পত্তি ২০০৬ সালে ‘ড. রবিশঙ্কর বনাম জেরি কে থমাস এবং অন্যান্য’ মামলায় অপারেশনের জন্য প্রস্তুতির অভাবকে রোগীদের যত্নের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতা হিসেবে গণ্য করেছে। এছাড়া ডায়াগনস্টিক পদ্ধতিতে অপর্যাপ্ততা বা সঠিকভাবে জীবাণুমুক্ত করার ব্যর্থতা ইত্যাদি চিকিৎসা-সংক্রান্ত অসদাচরণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
বাংলাদেশের আইনি কাঠামোয় সংবিধানকে সর্বোচ্চ আইন হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। সর্বোচ্চ আইন বলতে অন্য কোনো আইন বা আইনের ধারা, বিধান ইত্যাদি সংবিধানের কোনো বিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হলে সংবিধান প্রাধান্য পাবে এবং অন্য বিরোধপূর্ণ আইনটি বাতিল বলে গণ্য হবে। একই কারণে বর্তমানে ঘটে যাওয়া উল্লিখিত ঘটনাগুলোর যথাযথ বিচারিক প্রক্রিয়া নিশ্চিত করতে এবং রাষ্ট্রের স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা ব্যবস্থা নিয়ে জবাবদিহিতার প্রক্রিয়াকে ফলপ্রসূ করতে সংবিধানে স্বাস্থ্য ও চিকিৎসার বিধানগুলো পর্যালোচনার প্রয়োজন।
- ট্যাগ:
- মতামত
- ভুল চিকিৎসা
- চিকিৎসায় অবহেলা