পুরস্কার মানেই বিতর্ক
কেন বিতর্ক? ধরুন আপনার খুব ইচ্ছা হলো সমাজের সংস্কৃতিবানজনদের পুরস্কৃত করে কৃতজ্ঞতা জানাবেন। আপনার অভিজ্ঞান অনুসারে বাছাই করলেন চারজনকে, যাদের আপনি পুরস্কার দেওয়ার জন্য যোগ্য মনে করলেন। কারণ, আপনার নিজের তো সংস্কৃতি সংবেদনশীলতা আছে। কিন্তু আমি বা আপনার চারপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা সংস্কৃতিজনরা কী আপনার বাছাই করা চারজনকেই যোগ্য মনে করছেন? বা করবেন? প্রশ্নই আসে না। প্রতিজন চুলচেরা বিচার-বিশ্লেষণ করে দেখার চেষ্টা করবেন, আপনি অমুক আমলাকে কেন পুরস্কার দিলেন? অমুক বিখ্যাত লেখককে কেন রাখলেন না? অথবা মধ্যমানের একজন সংগীতশিল্পীকে আপনার পুরস্কারের তালিকায় রাখলেন? চতুর্থজনকে তো চিনবেই না। ফলে বিতর্ক না হওয়া ছাড়া পুরস্কারের মান বৃদ্ধি পায় না। পুরস্কার এক আজব দুনিয়া, বিশেষ করে বাংলাদেশে। বিচিত্র ধরনের, হরেক কিসিমের পুরস্কার আছে। অনেক সময় শোনা যায়, পনেরোজনকে অমুক প্রতিষ্ঠান পুরস্কার দিয়েছে। বিশাল আয়োজন করে পুরস্কার প্রদানের ছবি পত্রিকায় দেখি, দু-একটা চ্যানেলেও এক ঝলক দেখা যায় পুরস্কারপ্রাপ্তরা পুরস্কার হাতে দাঁড়িয়ে হাসছেন, অবশ্যই গর্বিত হাসি। পরে জানা যায়, ওই পনেরোজনের মধ্যে মাত্র তিন থেকে চারজন জেনুইন। তাহলে বাকিরা? ওনারা পুরস্কার ক্রয় করেছেন পুরস্কার প্রদান কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে। কত টাকা বা কী লেনদেন হয়েছে, সেটা ওনারাই জানেন, আমরা জানবার কে?
সবকিছু মিলে বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে পুরস্কার একটা ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। এই নৃশংস ব্যাধির কারণে যারা প্রকৃত সমঝদার, যথাযথ গুণিজনকে সংবর্ধনা দিয়ে পুরস্কৃত করতে চান, তারা পড়ে যান বিপাকে। ফলে গড়ে ওঠে বিতর্ক। চলে চায়ের কাপে ঝড়। তবুও পুরস্কার চলমান, চলবে, চলতে থাকবে। কিন্তু কীভাবে পুরস্কার প্রকৃত পুরস্কার হয়ে উঠতে পারে, ভাবা দরকার। অযথা বিতর্ক তৈরি করা একটা সুষ্ঠু সুনির্মল সমাজের কারও কাম্য নয়। প্রশ্ন হচ্ছে কীভাবে সম্ভব?
বিশিষ্ট নাট্যজন মামুনুর রশীদ একটি গোষ্ঠীর নিম্নরুচির বাগাড়ম্বর দেখে বলেছিলেন, দেশে রুচির দুর্ভিক্ষ ঘটেছে। সঙ্গে সঙ্গে সমাজের অনেকেই তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিলেন, মামুনুর রশীদের উক্তির বিপরীতে। অবাক হয়েছিলাম প্রকৃত রুচির দুর্ভিক্ষ দেখে। এবং মামুনুর রশীদ যথাযথই বলেছিলেন রুচির একেবারে নিম্নস্তরে পৌঁছে গেছি আমরা। কিন্তু একটা জাতি সম্প্রদায় যারা মাত্র বায়ান্ন বছর আগে ত্রিশ লাখ প্রাণ আর পাঁচ লাখ মায়ের ইজ্জত যুদ্ধের বিনিময়ে স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনতে পারে, তাদের মধ্যে এত দ্রুত নিম্নগামীর রুচি দেখা যাবে কেন? কোথাও কোনো ভুল ফুল ফুটছে? একটি জাতিকে যথাযথ প্রক্রিয়ায় সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য দরকার সুন্দর বিকশিত সুরুচি। দুঃখজনক হলেও সত্যি, সেই রুচির পরিধি আমাদের গড়ে ওঠেনি। বায়ান্নর মহান ভাষা আন্দোলনের পথপরিক্রমায় গড়ে ওঠা বইমেলায় একশ্রেণির লেখকদের নিম্নগামী দৌরাত্ম্য সেই প্রশ্ন আবার সামনে নিয়ে এসেছে। যত মানুষ তত পথ। সেই পথের যাত্রায় আমাদের নৈতিকতা, সাহস ও করণীয় নিয়ে ভাবা জরুরি।