ভাষার মাধ্যমে পাওয়া রাষ্ট্র ভাষার মাধ্যমেই হারাচ্ছি
আমাদের এই নতুন রাষ্ট্র যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, সেটা তো রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের পথ ধরেই। প্রথমে দাবি ছিল অন্যতম রাষ্ট্রভাষার। অর্থাৎ দুটি রাষ্ট্রভাষা থাকবে পাকিস্তানের, যার একটি হবে বাংলা। কিন্তু ওই আন্দোলনের মধ্যে পাকিস্তানের ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদকে প্রত্যাখ্যান করে ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদ গড়ে তোলার যে আকাঙ্ক্ষাটা ছিল, তা ক্রমাগত তীব্র হয়েছে এবং ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা ঘটিয়েছে। এই রাষ্ট্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা হবে– এটা ছিল স্বতঃসিদ্ধ; সাংবিধানিকভাবে সেটাই হয়েছে। কিন্তু হায়, রাষ্ট্রের ভাষা বাংলা হয়নি।
রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন কি উর্দুবিরোধী ছিল? হ্যাঁ, অবশ্যই। কিন্তু ছিল কি সে ইংরেজিবিরোধী? ‘হ্যাঁ’, সেটাও হওয়ার কথা ছিল বৈকি। কেননা, আন্দোলন ছিল বাঙালি নিজের পায়ে দাঁড়াবে, বাংলা ভাষার মধ্য দিয়ে একটি ধর্মনিরপেক্ষ ইহজাগতিক ও গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ে তুলবে, যেখানে মানুষের পরিচয় ধর্ম, সম্প্রদায় কিংবা অর্থনৈতিক শ্রেণির দ্বারা চিহ্নিত হবে না; পরিচয় হবে ভাষার দ্বারা।
কিন্তু রাষ্ট্র গণতন্ত্রের পথে যায়নি। বাংলাদেশে অন্তত একটি বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হবে, এই আশাটা ছিল। বৃষ্টিহীন দুপুরের রংধনুর মতোই সে-আশা মিলিয়ে গেছে। আশার স্মৃতিটা এখন পীড়া দেয় তাদেরকে, যাদের হৃদয় আছে। বাংলাদেশে সাবেক পাকিস্তানের মতোই একটি আমলাতান্ত্রিক পুঁজিবাদী রাষ্ট্র পুনঃস্থাপিত হয়েছে। গণতন্ত্রের মূল কথা যে অধিকার ও সুযোগের সাম্য; জনগণের ন্যূনতম নাগরিক অধিকারগুলোর কার্যকর স্বীকৃতি এবং রাষ্ট্রের বিকেন্দ্রীকরণ ঘটিয়ে সর্বস্তরের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের শাসন প্রতিষ্ঠা; তার কোনো কিছুই আজ বাংলাদেশে নেই।
বাংলাদেশের বিগত অর্ধশতকের ইতিহাসে একই ধারার সরকার শাসন করেছে। কখনও ছিল নির্বাচিত, কখনও অনির্বাচিত; তফাত ওইটুকুই। রাষ্ট্র ক্রমাগত শক্তিশালী হয়েছে; বিশেষ ক্ষমতা আইন এসেছে। এসেছে জননিরাপত্তা, ডিজিটাল, সাইবার নামক নিপীড়নের হরেক আইন। ওইসব আইন রাষ্ট্রের চরিত্রকে স্পষ্ট করে দিচ্ছে। এই রাষ্ট্র বস্তিবাসীকে উৎখাত করে; বলে, সন্দেহ হচ্ছে তোমরা খাঁটি সন্ত্রাসী, কিন্তু শেয়ারবাজার, উন্নয়নের অর্থ আত্মসাৎকারী, ব্যাংক লুটকারী, অর্থ পাচারকারী, প্রকৃত ও খুনের মামলার আসামি যে সন্ত্রাসী, তাকে সে পাহারা দেয়। এই রাষ্ট্র হুঙ্কারের, ধমকের ও হুকুমের। এর ভাষা জনগণের ভাষা অর্থাৎ বাংলা ভাষা হবে– এ সম্ভাবনা বহুভাবেই ক্ষীণ।
স্বাধীনতার পর যারা ক্ষমতায় এসেছে, তারা ইংরেজিবিরোধী ছিল না, বরং ইংরেজির দিকেই ঝুঁকে পড়েছিল। কেননা, ক্ষমতায় এসেছে মধ্যবিত্ত, যে-মধ্যবিত্ত পুঁজিবাদকেই আদর্শ মনে করে এবং শ্রেণিগতভাবে যারা মোটেই উপনিবেশবাদের বিরোধী নয়। এরা আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে পছন্দ করে। কেননা, আমলাতন্ত্র এদের নিয়েই গঠিত। পুঁজিবাদে এদের সুবিধা। কারণ ওই পথেই ধনী হওয়ার সম্ভাবনা। পরের নেতৃত্ব আগের নেতৃত্বকে ছাড়িয়ে গেছে এক ব্যাপারে। সেটা হলো পুঁজিবাদের জন্য পথ প্রশস্তকরণ। আর ওই বিশ্ব-অর্থনৈতিক ব্যবস্থার ভাষা তো বাংলা নয়। তার ভাষা হচ্ছে ইংরেজি।
রয়েছে নির্ভরতা। অর্থনৈতিকভাবে আমাদের রাষ্ট্র মোটেই স্বাবলম্বী নয়, বরং তার পরনির্ভরতা দিন দিন বাড়ছে। ঋণ-সাহায্য, এনজিও তৎপরতা, সবই রয়েছে পুরোদমে। রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক নীতি নির্ধারিত হয় ওয়ার্ল্ড ব্যাংক ও আইএমএফের নির্দেশ অনুযায়ী; এদের ভাষা বাংলা নয়। বাঙালি এখন জীবিকান্বেষণ ও শিক্ষালাভের আশায় বিদেশে যেতে পারলে যত খুশি হয়, তত খুশি কম জিনিসেই হয়ে থাকে। এ জন্য তাকে ইংরেজি শিখতে হয়।
- ট্যাগ:
- মতামত
- বাংলা ভাষা
- রাষ্ট্র ভাষা