জনগণের এক লাখ কোটি টাকা যেভাবে লুটপাট হলো!
বাংলাদেশে জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে কয়েকটি বৈশিষ্ট্য দেখা যাচ্ছে। আমদানি-নির্ভরতা, ঋণ-নির্ভরতা ও বিদেশি কোম্পানির ওপর নির্ভরশীলতা। এই তিনটি বৈশিষ্ট্য ক্রমান্বয়ে প্রকট হচ্ছে। এই তিন নির্ভরতার কারণে শুধু জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাত ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, এমন নয়। পুরো আর্থিক খাত ও সামগ্রিক অর্থনৈতিক অবস্থা বিপর্যস্ত হচ্ছে। রিজার্ভের ক্ষেত্রে বৈদেশিক মুদ্রার ওপর চাপ পড়ছে। তারপর গ্যাস, বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দাম বাড়ানোর চাপ তৈরি হচ্ছে। এতে দৈনন্দিন জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়ছে। এটি ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। এ পরিস্থিতি আকস্মিকভাবে আজকে থেকে ঘটছে, তা নয়। সরকার এই পর্যায়ে যে এসেছে, এটাকে একটা পরিকল্পিত যাত্রা বলা যায়।
২০১০ ও ২০১৬ সালের পাওয়ার প্লান্টের মাস্টারপ্ল্যান মূলত সরকারের পূর্বপরিকল্পনারই অংশ। কারণ আমাদের জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতের জন্য সহজ পথ ছিল। সহজ পথটা হলো, আমাদের নিজেদের গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলন করা। নিজেদের গ্যাস উত্তোলন করলে বৈদেশিক মুদ্রা খরচ হতো না। তারপর দামও অনেক কম পড়ত এবং বিদ্যুৎ উৎপাদনও হতো পরিবেশবান্ধব। সরকার সেই পথে যায়নি। নিজেদের গ্যাস অনুসন্ধান করে উত্তোলনের পথ বের করেনি। আমাদের সমুদ্রে এর বড় একটা সম্ভাবনা রয়েছে। এরই মধ্য দিয়ে জাতীয় সক্ষমতা বাড়ানো যেত, সেটা করা হয়নি। জাতীয় সক্ষমতা বাড়ালে তা জাতীয় মালিকানায় থাকে। এতে সবকিছুর দাম কম হয় এবং নিজেদের সুবিধা ও প্রয়োজন অনুসারে ব্যবহার করা যায়। বিদেশি কোম্পানির হাতে ছেড়ে দিলে সেটার দাম অনেক বেশি পড়ে এবং নির্ভরশীলতা তৈরি হয়। সরকার জাতীয় সক্ষমতা বাড়ায়নি এবং গ্যাস উত্তোলনেও মনোযোগ দেয়নি। বরং তা দিয়ে তারা এলএনজি গ্যাস আমদানি করেছে। যে পরিমাণ টাকা দিয়ে আমরা দেশের গ্যাস পাই; এলএনজি ব্যবহারে আমাদের বহু গুণ টাকা খরচ হয়। এই খরচের পুরোটা বৈদেশিক মুদ্রা। এসব গ্যাস ঋণ করে বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়।
২০১৭ সালে আমরা জাতীয় কমিটি থেকে সরকারকে গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনের জন্য বিকল্প মাস্টারপ্ল্যান দিয়েছিলাম। সেখানে আমরা দেখিয়েছিলাম, সরকারি মহাপরিকল্পনা অনুযায়ী যদি বাংলাদেশের জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাত অগ্রসর হয়, তাহলে তিনটা জিনিস বেড়ে যাবে– আমদানি, ঋণ এবং বিদেশি কোম্পানির ওপর নির্ভরশীলতা। বিদ্যুতের দামও বাড়বে। এগুলো ক্রমাগত বেড়ে যাচ্ছে। সামনের দিনগুলোতে আরও বাড়বে। ফলাফল হিসেবে বাংলাদেশের অর্থনীতির ওপর চাপ বাড়বে। বিকল্প হিসেবে দেখিয়েছিলাম, আমাদের কয়লার দরকার নেই; আমদানির দরকার নেই; পারমাণবিকও দরকার নেই। বরং আমাদের দুটি জিনিস দরকার। প্রথমত, নিজেদের গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলন। দ্বিতীয়ত, নবায়নযোগ্য জ্বালানি তৈরি। এই দুটোর জন্য জাতীয় সক্ষমতাও বাড়ানো দরকার। অর্থাৎ আমাদের এত বিশ্ববিদ্যালয়, অথচ নিজেদের গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলন কিংবা নবায়নযোগ্য জ্বালানির জন্য জাতীয় সক্ষমতা তৈরি হবে না– এটা হতে পারে না। এটাই ছিল আমাদের পরামর্শ। আমরা এও দেখিয়েছিলাম, যদি ওই পথ অনুসরণ করা হয়, তাহলে কমবে ঋণ-নির্ভরতা, আমদানি এবং বিদেশি কোম্পানির ওপর নির্ভরতা। গ্যাস ও বিদ্যুতের দামও কমে যাবে। এটি পরিষ্কারভাবে দেখানোর পরও সরকার সে পথে যায়নি।
২০১০ সালে সরকার যা শুরু করেছিল, তা ২০১৬, ২০১৭-এর পর আরও জোরদার করল। ফলে বাংলাদেশ এখন ভয়াবহ একটা বিপদের মধ্যে, যেখানে এলএনজির দাম বিভিন্ন সময় বেড়ে যাচ্ছে। আমদানিনির্ভর অর্থনীতির কারণে মানুষ অনিশ্চয়তার মধ্যে থাকে। আমদানি-নির্ভরতা কিংবা বিদেশি ঋণের ওপর নির্ভরতা মানেই ক্রমান্বয়ে দেশের সম্পদের ওপর চাপ সৃষ্টি করা। বিদেশি কোম্পানির ওপর নির্ভরতা মানেই জাতীয় নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে পতিত হওয়া। সরকার কী কারণে সেই পথে গেছে, তা আমাদের অনুসন্ধানে স্পষ্ট। সরকারের কাছে অগ্রাধিকার ছিল চীন, ভারত, রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানিগুলোকে সুবিধা দেওয়া, তাদের খুশি করা। দেশের মধ্যে যেসব বড় কোম্পানি আছে, তাদের খুশি করা। অর্থাৎ দেশের ও চারটি রাষ্ট্রের বড় বড় কোম্পানিকে খুশি করতে গিয়ে বাংলাদেশের জ্বালানি খাতে আজকে এ রকম সংকট তৈরি হয়েছে।
- ট্যাগ:
- মতামত
- জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাত
- অর্থ লুট