মিয়ানমার সংঘাত আর বাংলাদেশ সংকট
মিয়ানমার নিয়ে বাংলাদেশ কি ত্রিশঙ্কু অবস্থায় পড়তে যাচ্ছে? সংঘাত মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ হলেও বাংলাদেশের ঘাড়ে তার দায় কতটা এসে পড়বে? এ ধরনের প্রশ্ন আর আশঙ্কার কথা আলোচিত হচ্ছে। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটা কথা প্রচলিত আছে, অনেক কিছু পরিবর্তন করা গেলেও প্রতিবেশী পাল্টানো যায় না। এ বিষয়টা শুধু আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রেই নয়, পাড়া প্রতিবেশীর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। ব্যক্তিগতভাবে এক পাড়া থেকে অন্য পাড়া বা মহল্লায় চলে যাওয়া সম্ভব হলেও দেশের ক্ষেত্রে তা মোটেই সম্ভব নয়। প্রতিবেশীর ঘরের আগুন যেমন আশঙ্কা জাগায়, তেমনি বাড়তি সতর্কতা প্রয়োজন হয়। বাংলাদেশের দুই প্রতিবেশী। ভারত আর মিয়ানমার। তাদের সঙ্গে সম্পর্কের ধরন নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও, তাদের কারণে যে বাংলাদেশকে সংকটে পড়তে হয় তা নিয়ে বিতর্ক নেই। মিয়ানমার কর্র্তৃক সৃষ্ট রোহিঙ্গা সমস্যার বোঝা দিন দিন ভারী হয়ে উঠছে বাংলাদেশের কাঁধে। আর বর্তমান অভ্যন্তরীণ সামরিক সংঘাত রোহিঙ্গা সংকটের পাশাপাশি বাংলাদেশের সামনে আর একটি বড় ধরনের ভূরাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে। মিয়ানমারের পাঁচ প্রতিবেশী চীন, ভারত, বাংলাদেশ, থাইল্যান্ড ও লাওস সবার সঙ্গেই নানা সংকটে জড়িয়ে আছে দেশটি।
সম্পদে পূর্ণ আর অভ্যন্তরীণ জাতিগত সংঘাতে বিদীর্ণ এক দেশ মিয়ানমার। ১৯৪৮ সালে স্বাধীনতার পর থেকেই বিভিন্ন কায়দায় সামরিক বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে থাকার কারণে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির চর্চা যেমন দুর্বল, দুর্নীতি ও লুটপাটকেন্দ্রিক তেমনি দেশটির অর্থনীতিকে প্রায় পঙ্গু করে রেখেছে। আয়তনে বাংলাদেশের চেয়ে প্রায় চারগুণ বড় অর্থাৎ ৬ লাখ ৭৬ হাজার বর্গকিলোমিটারের চাইতে বড় মিয়ানমার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্যতম বৃহত্তম দেশ। জনসংখ্যা বাংলাদেশের তিন ভাগের এক ভাগ বা ৫ কোটি ৭৫ লাখের মতো। প্রাকৃতিক সম্পদ প্রচুর গ্যাস, তেল, কাঠ, নানা ধরনের খনিজ পাথর তো আছেই, কয়লা পাওয়ার সম্ভাবনাও বিপুল। এর সঙ্গে আছে নবায়নযোগ্য শক্তির এক বিশাল সম্ভাবনা। কিন্তু প্রাকৃতিক সম্পদ থাকলেও শোষণ লুণ্ঠনের কারণে যে বঞ্চনা ও দারিদ্র্য দূর হয় না, তার এক বেদনাময় দৃষ্টান্ত মিয়ানমার। সাতটি রাজ্য আর সাতটি অঞ্চল নিয়ে মিয়ানমার। জনসংখ্যার কম বেশি দুই-তৃতীয়াংশ বামার, বাকিরা ১৩৫টি স্বীকৃত এথনিক গ্রুপে বিভক্ত। এদের মধ্যে শান, কারেন, রাখাইন প্রধান হলেও তারা কেউই ১০ শতাংশের বেশি নয়।
১৯৬২ সাল থেকে দেশটি শাসন করছে সামরিক জান্তা। সব ক্ষেত্রে তাদের কর্র্তৃত্ব আর জাতিগত নিপীড়ন ও বৈষম্য অভ্যন্তরীণ সংহতি ক্রমাগত ধ্বংস করেছে। এর প্রতিক্রিয়ায় প্রতিটি রাজ্যেই বিক্ষোভ, বিদ্রোহ এবং বিদ্রোহী বাহিনী আছে। তারা সামরিক বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষেও জড়িত হয়ে পড়েছে। এর অংশ হিসেবে ২০২১ সাল থেকে দেশটির প্রধান ১৪টি জাতিগত গোষ্ঠীর দলগুলো মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী বা তাতমাদো সরকারের বিরুদ্ধে তাদের সংগ্রাম জোরদার করে। এসব জাতিগত গোষ্ঠীর অধিকাংশই দেশটির পশ্চিম-উত্তর ও পূর্বাঞ্চলে সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র লড়াইয়ে লিপ্ত ছিল। ২০২৩ সালের অক্টোবরে অপারেশন ১০২৭ নামে তিনটি জাতিগত বিদ্রোহী বাহিনী একজোট হয়ে জান্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে সমন্বিত আক্রমণ শুরু করে। এই তিনটি সশস্ত্র গোষ্ঠীর সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে থ্রি ব্রাদার্স অ্যালায়েন্স (থ্রি বিএইচএ)। এদের মধ্যে জনবল, সামরিক শক্তি ও কৌশলের দিক থেকে সবচেয়ে প্রভাবশালী সংগঠন হচ্ছে আরাকান আর্মি (এএ)। বাকি দুটি হচ্ছে কাচিন ইন্ডিপেনডেন্ট আর্মি ও তাং ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি। উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, এদের পক্ষে জনসমর্থন বেড়ে চলেছে। কিন্তু মিয়ানমারের পরিস্থিতির দ্রুত পরিবর্তন হতে থাকে ২০২০ সালের সাধারণ নির্বাচনের পর থেকে। সেই নির্বাচনে সাবেক স্টেট কাউন্সেলর অং সান সু চির ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি) সেনাসমর্থিত দলকে বিপুল ভোটে পরাজিত করে। নির্বাচনকালে সংবিধান সংশোধনের যে প্রতিশ্রুতি এনএলডি দিয়েছিল, তা সেনাবাহিনীর স্বার্থবিরোধী মনে হওয়ায় ২০২১ সালে সেনাবাহিনী নির্বাচিত সরকারকে হটিয়ে মিয়ানমারের জনপ্রিয় নেতা অং সান সু চিসহ শীর্ষ এনএলডি নেতাদের কারাগারে পাঠায়। ফলে সেনাশাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ প্রতিরোধ গড়ে ওঠে। কিন্তু এবার সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে যে প্রতিরোধ শুরু হয়, তা মিয়ানমারের ইতিহাসে অতীতে আর গড়ে ওঠেনি।