সুশাসন ও ন্যায়পাল প্রসঙ্গ
ব্যষ্টি ও সমষ্টির জীবনে ন্যায়নীতি-নির্ভরতার প্রত্যয়, শুদ্ধাচার বা সদাচার চর্চার তাৎপর্যময় আবশ্যকতার কথা তাবৎ ঐশীগ্রন্থে, ধর্ম প্রবর্তক-প্রচারকের বাণীতে, সক্রেটিস (খ্রি.পূর্ব ৪৭০-৩৯৯), প্লেটো (খ্রি.পূর্ব ৪৩৭-৩৪৭), এরিস্টটল (খ্রি.পূর্ব ৩৮৪-৩২২) এমনকি কৌটিল্যের (খ্রি.পূর্ব ৩৭৫-২৮৩) অর্থশাস্ত্রেও ছিল। সেই সদাচার শুদ্ধাচারের চর্চার অবলম্বন বা অনুসরণ যুগে যুগে নানান প্রেক্ষাপটে হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটেছে। সদাচার সুশাসন লোপ পেলে ব্যক্তি সমাজ সংসার নিপতিত হয়েছে নানান অরাজক পরিস্থিতিতে। মানবসমাজে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের সূচনা-বিকাশ-বিবর্তনও ঘটেছে শুদ্ধাচারের প্রতি আকিঞ্চন আকাক্সক্ষা ও দায়বদ্ধতা থেকে। শান্তি ও শৃঙ্খলার স্বার্থে, সহযোগিতা-সহমর্মিতার স্বার্থে, ন্যায়নীতি-নির্ভরতার স্বার্থে ও তাগিদে সুশাসনকে অগ্রগণ্য সাব্যস্ত করা হয়েছে। ন্যায়নীতি-নির্ভরতার মূল্যবোধ যে সমাজে যত বেশি বিকশিত, পরিপালিত, অনুসৃত হয়েছে সে সমাজ তত সাফল্যের শিখরে পৌঁছাতে পেরেছে। বিপরীত অবস্থায় বিপন্ন-বিপর্যস্ত হয়েছে বহু সমাজ ও সম্প্রদায়।
বায়ান্ন থেকে তিপ্পান্নয় পা রাখা বাংলাদেশে সর্ববিধ বিচার-বিবেচনায় ভৌত অবকাঠামোগত উন্নতির চমক দেখানোর বিপরীতে রয়েছে নিরাপত্তা হেফাজতে মৃত্যু, রাজপথে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে এবং ক্ষেত্রবিশেষে তাদেরও বেপরোয়া আচরণ, বিদেশে বিপুল অর্থপাচারের মতো সিন্ডিকেটেড আস্ফালন। দারিদ্র্য পরিবেশ-পরিস্থিতিকে উপেক্ষা বরং সর্বত্রগামী দুর্নীতির অগ্রযাত্রায় অর্থনীতির সমূহ সর্বনাশ সাধন, সেবাধর্মী সরকারি প্রতিষ্ঠানে দুর্নীতির প্রতিকার না পাওয়ার মতো বিষয়গুলো দিন দিনই সাধারণ মানুষকে যাতে আরও উদ্বিগ্ন করে না তোলে, কিংবা কোনো কোনো ক্ষেত্রে কার্যকলাপ জবাবদিহির বাইরে চলে যাওয়ার মতো ঘটনার প্রতিকার পেতে একজন সাংবিধানিক ন্যায়পালের আবশ্যকতা উঠে আসছে। সংবিধান বিশেষজ্ঞরা অভিমত প্রকাশ করছেন, ন্যায়পাল সরকারের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করবে, সরকারি প্রতিষ্ঠানকে আনবে জবাবদিহির মধ্যে। তাদের মতে ন্যায়পাল থাকলে সরকারকে মুখোমুখি হতে হবে না অনেক বিব্রতকর পরিস্থিতিরও। চাণক্য প-িতের মতো অনেকে এটাও বলছেন, ন্যায়পাল প্রতিষ্ঠান সরকারের প্রশাসনকেও শক্তিশালী করতে পারে। কেননা মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতির কারণে সরকারের প্রতি আস্থা হারাতে পারে সাধারণ মানুষ রাষ্ট্রীয় কাঠামোর প্রতি এই আস্থাহীনতাই জন্ম দেয় সামাজিক অনাচার ও রাজনৈতিক সহিংসতার।
মানুষ বিশ্বাসের বিশ্বে বাস করে। পরস্পরের প্রতি আস্থায় বিশ্বাসের ভিত রচিত হয়। আস্থার সংকট তৈরি হলে পরাধীনতার প্রতিভূ হয়ে দাঁড়ায় সহমত, সহাবস্থানের। ঔপনিবেশিক শাসন প্রশাসন যন্ত্রের যাবতীয় অন্যায়-অনিয়ম ও শোষণ বঞ্চনা রহিত করে সুশাসন সদাচারী সমাজ বিনির্মাণের আকাক্সক্ষা থেকেই ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগ এবং ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে রক্তত্যাগের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা। স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্য ন্যায়পাল নিঃসন্দেহে অনিবার্য বিষয়। বাংলাদেশের সংবিধানের অনন্য বৈশিষ্ট্যগুলোর একটি হলো ন্যায়পালের বিধান। প্রশাসনের অনিয়ম-অব্যবস্থা দূর করতে সংবিধানে ন্যায়পালের বিষয়টি সংস্থাপিত হয়। ন্যায়পালের সহযোগিতায় সরকার শুদ্ধাচারের অনুশীলন নিয়ে এগিয়ে যেতে পারে। একটি উন্নত রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে উঠতে অব্যবস্থা, অনিয়ম এবং দুর্নীতি দূর করার জন্য জাতীয় পর্যায়ে সম্মিলিত প্রয়াস প্রয়োজন। এটা তখনই সৃষ্টি হতে পারে যখন এই প্রয়াসে সব শ্রেণি ও পেশার মানুষ শামিল হবে।
- ট্যাগ:
- মতামত
- সুশাসন প্রতিষ্ঠা