সংকটে মিয়ানমার সেনাবাহিনী : বিরোধীরা কতটা প্রস্তুত
দশকের পর দশক ধরে মিয়ানমার সেনাশাসিত। এর মাঝে কিছুটা সময়ের জন্য গণতন্ত্রের সুবাতাস পেলেও দেশটির জনগণ এবং রাজনৈতিক দলগুলোর সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কারণে ক্ষমতা সীমিত হওয়ায় অনেক কিছুই তারা করতে পারেনি। মিয়ানমারে সেনাবাহিনীর আধিপত্য বহু দশক ধরে চলে আসছে। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের কাছে মিয়ানমারের রাজতন্ত্রের পতনের পর মিয়ানমার ব্রিটিশ ভারতের নিয়ন্ত্রণে আসে। মিয়ানমারের রাজনীতিতে তখনকার অবস্থা থেকে স্বাধীনতার জন্য ছাত্রদের মধ্যে থেকে ৩০ কমরেডের মাধ্যমে বার্মা আর্মি সংগঠিত হয়। এরাই পরবর্তীকালে স্বাধীনতা সংগ্রামের মাধ্যমে প্রথমে জাপান ও পরে ব্রিটিশদের মিয়ানমার ছাড়া করে স্বাধীনতা লাভ করে। ঔপনিবেশিক শাসনামলের ডিভাইড অ্যান্ড রুল নীতির বিপরীতে জেনারেল অং সাং পাংলং কনফারেন্সের মধ্য দিয়ে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীগুলোকে একত্র করে একটা ফেডারেল মিয়ানমারের স্বপ্ন বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। মিয়ানমারের স্বাধীনতার কিছুদিন আগে আততায়ীর হাতে নিহত হওয়ায় তিনি তা বাস্তবায়ন করতে পারেননি।
ব্রিটিশদের কাছ থেকে স্বাধীনতালাভের পর মিয়ানমারে গণতান্ত্রিক সরকার গঠিত হলেও ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর সঙ্গে সংখ্যাগরিষ্ঠ বামারদের মধ্যকার বিভেদ ও আস্থার অভাব রয়েই যায়। সে সময় থেকেই তারা তাদের অধিকার আদায়ের জন্য সশস্ত্র দল গঠন করে এবং সংগ্রাম চালিয়ে যেতে থাকে। সীমান্তবর্তী অঞ্চলগুলোতে মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীগুলোর সশস্ত্র সংগঠনগুলোর (ইএও) মধ্যে দশকের পর দশক ধরে সংঘর্ষ চলতে থাকে। পরবর্তীকালে ১৯৬২ সালে সেনা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে নে উইনের ক্ষমতা দখলের পর থেকে বামার নিয়ন্ত্রিত মিয়ানমার সেনাবাহিনী দেশের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীগুলোর ওপর তাদের দমনপীড়ন চালিয়ে যেতে থাকে এবং দশকের পর দশক ধরে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ চলে।
২০১১ সালে মিয়ানমারে রাজনীতির চর্চা, অর্থনৈতিক সংস্কার ও উন্নয়ন প্রক্রিয়া শুরু হয়। ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্র্যাসি (এনএলডি) একটা গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা করে। পরবর্তীকালে তারা ২০২০ সালের নির্বাচনে জয়ী হয়। গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রা চলমান রাখা এবং মিয়ানমারের জনগণ সেই সুফল পুরোপুরি পাওয়ার আগেই ২০২১ সালে সেনাবাহিনীর ক্ষমতা গ্রহণের মধ্য দিয়ে তার অবসান ঘটে। সামরিক শাসনের প্রতিবাদে দেশব্যাপী বিক্ষোভ এবং পরবর্তীকালে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। সেনাবাহিনী আগের মতোই দমনপীড়নের মাধ্যমে অশান্ত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করে। এবার তাদের নিপীড়নের সেই পুরোনো পদ্ধতি কাজ করেনি এবং জনতা সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। স্বাধীনতাকামী ছাত্র ও যুবকদের সঙ্গে এবার সংখ্যাগরিষ্ঠ বামার তরুণরা সেনাশাসনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়। তরুণ সমাজের একাংশ, বেসামরিক নেতাকর্মী, ইএও এবং সেনাশাসনের বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ সাধারণ নাগরিকরা এবার সশস্ত্র সংগ্রামে জড়িয়ে পড়ে। মিয়ানমারের গণতন্ত্রমনা জনগণ এখন একতাবদ্ধ হয়ে দেশকে সামরিক শাসনমুক্ত করার জন্য প্রাণপণ লড়াই করে যাচ্ছে।
২০২১ সালে জাতীয় ঐক্য সরকার (এনইউজি) গঠিত হয়। বর্তমানে সেনাশাসনবিরোধী রাজনৈতিক জোট এনইউজি এবং তাদের সামরিক শাখা পিপলস ডিফেন্স ফোর্স (পিডিএফ), ইএও সমন্বিতভাবে জান্তার বিরুদ্ধে আক্রমণ পরিচালনা করছে। মিয়ানমার ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স আর্মি, তাং ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি এবং আরাকান আর্মি-এ তিনটি সশস্ত্র সংগঠন ২০২৩ সালের অক্টোবরে তাদের নিজেদের মধ্যকার বিভেদ মিটিয়ে একত্রে ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স গঠন করে ‘অপারেশন ১০২৭’ নামে জান্তার বিরুদ্ধে একযোগে আক্রমণ শুরু করে।