কর্মই তাঁকে বাঁচিয়ে রাখবে
সন্তোষ গুপ্তের দর্শনভিত্তিক লেখাগুলো পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণে ভীষণ সফল হয়েছিল। আপাত অর্থে ১৯৬২ সালে কমিউনিস্ট পার্টি থেকে সরে দাঁড়ানো এবং সমাজতান্ত্রিক চিন্তা সম্পর্কে তাঁর মতামতের নিজস্বতার প্রয়োগ থাকলেও তিনি অকপটে তা বলে গেছেন। তাঁর মতে, যেসব দেশে কমিউনিস্ট পার্টি ক্ষমতা দখল করেছে, তারা সবাই একটি মডেলই ব্যবহার করেছে। তিনি বলেছেন ক্রুশ্চেভের সংশোধনবাদ ও স্ট্যালিনের শ্রমশিবিরের কথা। তিনি বহু লেখক-শিল্পী নির্যাতনের সূত্র ধরে ও অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক সংকট নিয়েই সমাজতান্ত্রিক সমাজের অন্য ইতিহাস লিখেছেন। আবার তাঁরই গ্রন্থ ‘স্মৃতি-বিস্মৃতির অতলে’ পড়তে গিয়ে আমরা দেখি বাংলাদেশের রাজনীতির কট্টর সমালোচনা। সেখানে প্রধান কোনো রাজনৈতিক দলই বাদ পড়েনি। তাঁর ‘অনিরুদ্ধ’ কলামের সঙ্গেও অনেকের দ্বিমত রয়েছে। কিন্তু তাঁর যুক্তিকে ফেলে দেওয়ার পথ নেই। সন্তোষ গুপ্তের লেখায় যুক্তিবাদ যেমন প্রখর ছিল, তেমনি তথ্যেরও ছিল ব্যাপকতা। তাঁর লেখ্য শৈলীর গতিশীলতা পাঠককে বিমোহিত করত। যে কারণে স্যাটেলাইটের যুগেও অনিরুদ্ধকে কেউ ভোলেনি, ভুলবে না।
ব্যক্তিগত জীবনে সৎ, অসাম্প্রদায়িক, প্রগতিশীল ও বাম মতাদর্শের প্রতি অবিচল আস্থাশীল এই মনীষী সব সময় বলতেন, আমি একজন সাচ্চা মার্ক্সবাদী বলেই কমিউনিস্ট পার্টির সমালোচনা করতে দ্বিধা করিনি। সন্তোষ গুপ্ত ১৯২৫ সালের ৯ জানুয়ারি ঝালকাঠি জেলার রুনসী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ছেলেবেলায় মাত্র ১৫ দিনের ব্যবধানে বাবা ও কাকাকে হারান। ছেলেবেলা থেকেই তাঁর যে পাঠাভ্যাস গড়ে ওঠে, জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তা অটুট ছিল। তাঁর শৈশবের একটি ঘটনা এখনও সবাইকে বিস্মিত করে। তিনি একনাগাড়ে রবীন্দ্রনাথের ৪৪টি কবিতা মুখস্থ বলে তাঁর শিক্ষক মহেন্দ্র বাবুকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন।
শিক্ষক সন্তোষ গুপ্তের আশ্চর্য মেধাশক্তি দেখে ‘সঞ্চয়িতা’ ও ‘চয়নিকা’ বই দুটি উপহার দিয়েছিলেন। শৈশবে তাঁর সেই পড়াশোনার ভিত্তি তাঁকে বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির পুরোধা ব্যক্তিত্বে পরিণত করতে ভূমিকা রেখেছে।
১৯৪৪ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন কলকাতার রাইটার্স বিল্ডিংয়ে আইজি প্রিজন অফিসে সন্তোষ গুপ্ত কর্মজীবন শুরু করেন। দেশভাগের পর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের কারা বিভাগের আইজির অফিসে তাঁর পোস্টিং হয়। ১৯৭১ সালে তিনি প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের তথ্য বিভাগে কর্মরত ছিলেন। ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের ঘটনার পর এবং সে বছর ৩ নভেম্বর জাতীয় চার নেতা হত্যার ঘটনায় তিনি অশুভ শক্তির প্রতি তীব্র ঘৃণা প্রকাশ করে সেই প্রতিকূল সময়ে গণতন্ত্রের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন। বামপন্থিরা স্ব-উদ্যোগে এগিয়ে আসবেন; কামনা করেছিলেন তিনি। এ প্রশ্নে বামপন্থিদের সংকীর্ণতা দেখে পরে ক্ষুব্ধ হয়েছেন। তাই বলে যৌবনের ক্ষুরধার যে বিশ্বাস নিয়ে পথচলা শুরু করেছিলেন, সেই বিশ্বাস থেকে বিচ্যুত হননি কোনোদিন। বাংলাদেশের আর্থসামাজিক অবস্থার সঙ্গে শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতির মেলবন্ধন তাঁকে সব্যসাচী লেখক হিসেবে পরিচিত করেছে। সাংবাদিকতা ও সাহিত্যে আবদান রাখার জন্য স্বাধীনতা পুরস্কার, একুশে পদক, বঙ্গবন্ধু পুরস্কার, জহুর হোসেন স্মৃতি পদকসহ বিভিন্ন সম্মানে তিনি ভূষিত হয়েছেন। সন্তোষ গুপ্ত বেঁচে থাকবেন তাঁর কর্মের মধ্যে।
- ট্যাগ:
- মতামত
- জন্মদিন
- শিক্ষক
- বাংলা সাহিত্য