রাষ্ট্র এখন যেখানে দাঁড়িয়ে, সেখানে ভালো কিছু দেখছি না
মো. আবদুল মতিন। সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি। তাঁর উল্লেখযোগ্য বই: আনরিটেন কন্সটিটিউশন অব বাংলাদেশ, এ টেল অব টু সুপ্রিম কোর্টস। প্রথম আলোর সঙ্গে তিনি কথা বলেছেন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন, বিরোধী দলের আন্দোলন, মানবাধিকার, বিচারব্যবস্থা ইত্যাদি বিষয়ে। বাংলাদেশ ঘিরে ভূরাজনীতি ও বৈশ্বিক চাপ নিয়েও আলাপ করেছেন।
বাংলাদেশে ২০২৩ সালটি শুরু হয়েছিল রাজনৈতিক আন্দোলন-সংগ্রাম নিয়ে। বলতে গেলে বছরজুড়েই এই অবস্থা ছিল। বছরের শেষে এসে আপনার পর্যবেক্ষণ কী?
মো. আবদুল মতিন: আশাবাদী হওয়া যায়, এমন কিছু ঘটেনি। তবে বছরের শুরুতে রাজনীতিটা মোটামুটি ভালোভাবেই চলছিল। বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলো শান্তিপূর্ণ সভা-সমাবেশ করে তাদের দাবিদাওয়ার কথা দেশবাসীকে জানিয়েছিল। তাদের অহিংস আন্দোলনে সারা বছরই রাজপথ সরগরম ছিল। পাশাপাশি সরকারি দলও সভা-সমাবেশ করেছে।
বিএনপির এক দফা দাবি ছিল, দলীয় সরকারের পদত্যাগ করে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ বলেছিল, তারা পদত্যাগ করবে না। শেষ পর্যন্ত সংঘাতের মধ্যেই আন্দোলনের একটি পর্ব শেষ হলো। দুই পক্ষের এই অনড় অবস্থানকে কীভাবে দেখছেন?
আবদুল মতিন: দুই পক্ষই রাস্তায় সমস্যা সমাধান করতে চেয়েছে। কিন্তু গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান হতে হয় আলোচনার টেবিলে। বিএনপি যেমন এক দফার বিষয়ে অনড় ছিল, তেমনি আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্বও বলেছেন, বিএনপির সঙ্গে কোনো কথা নয়। দুই পক্ষের এই অনড় অবস্থান দেশকে অনিশ্চয়তার মধ্যে ঠেলে দিল। আমরা নাগরিকেরা আশা করেছিলাম, আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান হবে। সব দেশে সেটাই হয়ে থাকে। এরপর ২৮ অক্টোবরের ঘটনা সব আশা চুরমার করে দিল। একদিকে হাজার হাজার সাউন্ড গ্রেনেড ও কাঁদানে গ্যাসের শেল নিক্ষেপ করে বিরোধী দলের সমাবেশ ভেঙে দেওয়া হলো। অন্যদিকে প্রধান বিচারপতির বাসভবনে হামলা ও একজন পুলিশ সদস্যকে হত্যার ঘটনা ঘটল, যা খুবই দুঃখজনক। এটি কারা করেছেন, তা প্রমাণের আগেই সরকার বিএনপির মহাসচিবসহ অনেক নেতাকে গ্রেপ্তার করল। ফলে আলোচনা ও সমঝোতার সব পথ বন্ধ হয়ে গেল। দেশ গভীর অনিশ্চয়তায় পড়ল।
এর প্রতিবাদে বিরোধী দল যে হরতাল-অবরোধের ডাক দিল, সেটি কতটা জনসমর্থন পেয়েছে?
মো. আবদুল মতিন: যখন সভা-সমাবেশ করার সুযোগ থাকল না, তখন তারা হরতাল–অবরোধ রাজনৈতিক কর্মসূচি নিল। তাদের কাছে বিকল্প ছিল না। হরতাল–অবরোধকে কেন্দ্র করে দেশের বিভিন্ন স্থানে গাড়িতে-ট্রেনে আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটল। আবার এই আগুন দেওয়া নিয়ে দুই পক্ষ পরস্পরের ওপর দোষ চাপাচ্ছে। এই দোষারোপ ও গুজবের ডামাডোলে প্রকৃত সত্য হারিয়ে গেল।
সরকার বিরোধী দলের আন্দোলন ঠেকাতে গণগ্রেপ্তারের পথ বেছে নিয়েছে, যা দেশের ভেতরে ও বাইরে ব্যাপকভাবে সমালোচিত। কিন্তু বিএনপির পক্ষেও এক দফায় অনড় না থেকে বিকল্প কোনো পথ ছিল কি না?
মো. আবদুল মতিন: আমি মনে করি, বিরোধীদেরও আলোচনার পথটি খোলা রাখা উচিত ছিল। তবে পরিস্থিতি শান্তিপূর্ণ সমাধানের বাইরে চলে যাওয়ার জন্য বিদেশি হস্তক্ষেপও কম দায়ী নয়। আমাদের প্রতিবেশী একটি দেশ গণতন্ত্রের চেয়ে বাংলাদেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা তথা বর্তমান সরকারের ক্ষমতায় থাকার ওপরই জোর দিল। অন্যদিকে বিরোধী দলও আন্দোলন পরিচালনার ক্ষেত্রে জনশক্তির চেয়ে পশ্চিমা শক্তির ওপরই বেশি নির্ভর করেছে বলে জনমনে ধারণা আছে। যেকোনো কারণেই হোক ২৮ অক্টোবরের পর পশ্চিমা দেশগুলোর হঠাৎ নীরব হয়ে যাওয়া নিয়েও জনমনে প্রশ্ন উঠেছে।