মন্দা আক্রান্ত ২০২৩, সামনে কী?
যার শেষ ভালো তার সব ভালো-এ কথাটা কার, আমার জানা নেই। তবে এর ওপর আমার বিশ্বাস ছিল ভাসা ভাসা। ২০২৩ সালের শেষদিকে আমার সে বিশ্বাস বদলেছে। এ বছরটি যে ভালো যায়নি তা এর শেষ দেখেই বলা যায়। আমি বলছি মূল্যস্ফীতির নিরিখে। ২০২৩ সালের শুরুতে কত ছিল জিনিসপত্রের দাম, আর এখন কত? ভরা শীতকাল, আলুর সময়, শাকসবজির সময়। নতুন আলুর কেজি ৭০-৮০ টাকা। পেঁয়াজের ঝাঁজ কিছুটা কমেছে। নতুন পেঁয়াজের কেজি ১০০ টাকা, পুরোনোটা ১৮০ টাকা। ২০২৩ সালের শেষে এখন ভরা শীতকালে মুলা ৪০ টাকা কেজি, কাঁচামরিচ ১৬০ টাকা, ফুলকপি একটা ৫০ টাকা, বেগুন ১০০ টাকা কেজি, করলা ১২০ টাকা, শসা ৭০ টাকা, টমেটো ১০০ টাকা, পেঁপে ৪০ টাকা কেজি, আর একটা লাউ ১০০ টাকা। তালিকা বড় করে লাভ নেই। সব জিনিসপত্রের দাম কতটা বেড়েছে তা পাঠকরা জানেন। এ মূল্যবৃদ্ধি মূল্যস্ফীতির নিরিখে বিচার করলে ২০২৩ সালের শেষটা ভালো নয়। অতএব, বলা চলে পুরো বছরটিই ভালো যায়নি। অন্তত সাধারণ মানুষ, নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তের জন্য। এই শ্রেণির লোকের জন্য ২০২৩ সাল ছিল হতাশার বছর, ঋণের বছর, বড় কষ্টের বছর।
আর কৃষকের জন্য? কৃষক ধান ফলিয়েছে অনেক। সরকারের প্রত্যাশাও বেশি। কিন্তু সেই ধানের ক্রেতা নেই। হরতাল-অবরোধে বাজার মন্দা। আশুগঞ্জের মোকামে সিলেট থেকে ধান আসে কম, বেচাকেনা কম। কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত। পাটের দাম? পাটেরও বাজার নেই। গত মৌসুমে কৃষক পাটের দাম পেয়েছে ৩ হাজার থেকে ৩ হাজার ২০০ টাকা। এবার পাটের মন মাত্র ১৮শ থেকে ২ হাজার টাকা। অথচ এক মন পাট ফলাতেই লাগে এ টাকা। তাহলে দেখা যাচ্ছে, সাধারণ কৃষকের হিসাবেও ২০২৩ সাল ছিল বেদনা-কষ্টের দিন। এর অর্থ কী? সাধারণ কৃষক, নিম্নবিত্ত, গরিব, মধ্যবিত্ত যদি ভালো না থাকে, মূল্যস্ফীতির অত্যাচারে জর্জরিত থাকে, তাহলে অর্থনীতির অবস্থা কী হতে পারে? দৃশ্যত মূল্যবৃদ্ধির চাপে মানুষ কেনাকাটা কমিয়েছে। ডিম, পেঁয়াজ, কাঁচামরিচ, আলুর বাড়তি দাম দিতে দিতে ২০২৩ সাল গেছে দুঃস্বপ্নের মধ্যে। এর ফলাফল কী? জিডিপির প্রাক্কলনের পরিসংখ্যান দেখেই বোঝা যাচ্ছে ২০২৩-২৪ সাল কেমন আছে। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের মতে, আমাদের জিডিপি প্রবৃদ্ধি হতে পারে মাত্র ৬ দশমিক ২ শতাংশ। সরকার সাড়ে ৭ শতাংশ থেকে জিডিপির প্রাক্কলন এখন করেছে ৬ দশমিক ৫ শতাংশ। মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা হচ্ছে ৬ শতাংশ, যা এখন প্রায় ১০ শতাংশ। সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোর মতে, শীতকালীন ফসল ইত্যাদির নিরিখে মূল্যস্ফীতি কমবে। কিন্তু ডিসেম্বর শেষে যা দেখা যাচ্ছে তাতে মূল্যস্ফীতি কমার সম্ভাবনা কম। বিশেষ করে যখন ডলারের দাম শনৈঃশনৈঃ বাড়ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলে, ডলারের দাম ১১০-১১২ টাকা। অথচ খোলাবাজারে কেন, ব্যাংকই লুকিয়ে ডলার বিক্রি করে ১২০-১২২ টাকায়। ডলারের রিজার্ভ ২০ বিলিয়নের (এক বিলিয়ন সমান শতকোটি) নিচে চলছে অনেকদিন ধরে। ডলারের দাম ২০২৩ সালে টাকার বিপরীতে অনেক বেড়েছে। টাকার অবমূল্যায়ন ঘটেছে ২৫-৩০ শতাংশ। এ প্রেক্ষাপটে আমাদের ৪ দশমিক ৭০ বিলিয়ন ডলার ঋণ নিতে হয়েছে আইএমএফ থেকে। ২০২৩ সালে আমরা দুই কিস্তি ঋণের ডলার পেয়েছি।
ডলার সংকট অনেক কারণে। রপ্তানি আয় আশানুরূপ নয়, আমদানি বেশি। রেমিট্যান্সও আশানুরূপ নয়। বৈদেশিক সাহায্য ও ঋণের পরিমাণও কম। ডলার যত আসছে তার চেয়ে খরচ হচ্ছে বেশি। আগের ঋণের আসল ও সুদও দিতে হচ্ছে। ২০২৩ সালের জুলাই-অক্টোবরে রপ্তানি বেড়েছে গত বছরের তুলনায় মাত্র ৩ শতাংশ। এখানে প্রশ্ন আছে রপ্তানির পরিসংখ্যান নিয়ে। বাংলাদেশ ব্যাংক এবং রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর মধ্যে হিসাবের তফাৎ বিশাল। আমদানির পরিমাণ অবশ্য ভালোই কমেছে জুলাই-সেপ্টেম্বরে। কমেছে প্রায় ২৪ শতাংশ। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, মূলধনী যন্ত্রপাতি, কাঁচামাল, মধ্যবর্তী পণ্য-সবকিছুর আমদানিই ২০২৩ সালে কমেছে। এতে শিল্প-করখানায় উৎপাদন হ্রাস পেয়েছে। ইস্পাত কারখানা, সিমেন্ট ইত্যাদি খাতে উৎপাদন হ্রাস পাচ্ছে।