একজন স্বনির্মিত শিল্পোদ্যোক্তা
সদ্যপ্রয়াত, এ মুহূর্তে বাংলাদেশের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় শিল্প পরিবার সিটি গ্রুপের কর্ণধার, ফজলুর রহমান ছিলেন একজন স্বনির্মিত সফল শিল্পোদ্যোক্তা। এ সহস্রাব্দের শুরু থেকে (২০০০-০১ সালে বিনিয়োগ বোর্ডে এবং ২০০৭-০৯ সালে এনবিআরের চেয়ারম্যান হিসেবে কর্মরত থাকার সুবাদে) তার সঙ্গে ছিল আমার সুহৃদ সম্পর্ক। আত্মশক্তিতে বলবান, সম্পূর্ণ নিজ উদ্যোগে, আত্মমর্যাবোধে বিশ্বাসী ফজলুর রহমান সাহেবকে পোষক প্রতিষ্ঠানের আনুকূল্য, সুদৃষ্টি কিংবা আনুকূল্য প্রত্যাশায় বসে থাকতে দেখিনি। তিনি আপন মনের তাগিদে, আপন স্বপ্ন বাস্তবায়নে নিষ্ঠাবান ছিলেন। বিনিয়োগ বোর্ডে আমাদের সহকর্মী আবদুর রাজ্জাক দীর্ঘদিন তাকে পরামর্শ দিয়েছেন, বেজার চেয়ারম্যান পদ থেকে অবসরে যাওয়ার পর আমাদের কর্মনিষ্ঠ আত্মিক সহকর্মী পবন চৌধুরী স্বেচ্ছায় ফজলুল রহমান সাহেবের প্রকৃতিবান্ধব শিল্পোদ্যোগকে উৎসাহিত করতে তার প্রতিষ্ঠানে প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে যোগ দিয়েছেন। পাবলিক সেক্টরে পোষক প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ পদ থেকে দেশের শিল্পায়নে প্রাইভেট সেক্টরের সৃজনশীল কাজে চৌধুরীর এ যোগদান অবশ্যই একটি অনুসরণীয় পদক্ষেপ মনে হয়েছে। ফজলুর রহমান সাহেব এভাবেই পাবলিক প্রাইভেট সেক্টরের মেলবন্ধন ও মিথস্ক্রিয়ার সুযোগ ও সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়েছেন। আর ১০ জনের মতো এনবিআরের কাছে শুল্ক ও কর সুবিধা চাওয়া-পাওয়া নিয়ে তেমন কোনো দাবি-দাওয়ার পক্ষপাতী তিনি ছিলেন না। তার এবং তার শিল্প পরিবারের সঙ্গে বেজা, এনবিআর কিংবা ব্যাংকগুলোর সঙ্গে অতি মাখামাখির ঘটনা শুনিনি।
স্বাধীনতার ৫৩ বছরে বাংলাদেশের অনেক অর্জনের মধ্যে একটি দেশীয় উদ্যোক্তা শ্রেণী গড়ে ওঠা। এ উদ্যোক্তাদের কারো কারো পারিবারিক ব্যবসার ঐতিহ্য ছিল। কারো কারো ব্যবসা শুরুর মতো মূলধন ছিল। বিপরীতে কারো কারো অর্থকড়ি, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ও অভিজ্ঞতা—কিছুই ছিল না। দেশের যেসব উদ্যোক্তা সম্পূর্ণ নিজের চেষ্টা, উদ্যোগ ও মানুষের কাছ থেকে শিখে শূন্য থেকে বড় শিল্পোদ্যোক্তায় পরিণত হয়েছেন, দেশের শিল্পায়নের ভিত তৈরি করেছেন, মানুষের কাজের ব্যবস্থা করেছেন, তাদের একজন সিটি গ্রুপের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফজলুর রহমান (৬ মে ১৯৩৭ থেকে ২৫ ডিসেম্বর ২০২৩)। ১৯৭২ সালে সরিষার তেল প্রস্তুতকারক কোম্পানি হিসেবে যাত্রা শুরু করে, বর্তমানে সিটি গ্রপের অধীনে প্রায় ৪০টি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। সেখানে ৩০ হাজার কর্মীর কর্মসংস্থান হয়েছে, তাদের বার্ষিক টার্নওভার প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা। উইকিপিডিয়া এবং ২০২১ সালের ২৪ অক্টোবরের সন্ধ্যায় প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমানের কাছে দেয়া তার একান্ত সাক্ষাৎকারে দেয়া বক্তব্য (প্রথম আলোয় পুনঃপ্রকাশ ২৫ ডিসেম্বর ২০২৩) থেকে যা জানতে পারি—ফজলুর রহমানের মোট ১১ ভাই-বোন ছিলেন, যার মধ্যে ফজলুর রহমান ছিলেন দ্বিতীয়। বাবা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে যাওয়ায় ১৯৫৮ সালে ১১ বছর বয়সে মাত্র ৪২ টাকা পুঁজিতে একটি পানের দোকানের মাধ্যমে কর্মজীবন শুরু করেন ফজলুর রহমান। তিনি আর তার বড় ভাই মিলে দোকান দেন। তার বড় ভাই কমলাপুরে ফুফাতো ভাইয়ের দোকানে কাজ করতেন। সেখানে খাওয়া-দাওয়ার বেশ অনিয়ম হতো। বাবা তাকে বাড়িতে চলে আসতে বলেন। তারপর দুই ভাই মিলে দোকান করলেন। নিজের আত্মবিশ্বাস, আত্মমর্যাদা বোধকে সম্বল করে তিনি চলেছেন সারা জীবন।
মতিউর সাহেবের কাছে সাক্ষাৎকার দেয়ার সময় তিনি উল্লেখ করেন—‘আমি একবার আমার এক চাচার কাছে গেলাম। তিনি তার ব্যবসায় আমাকে যোগ দিতে বললেন। আমি চাচাকে বললাম, তিনি যদি আমাকে পড়াশোনা করতে বলতেন, সব খরচ দেবেন বলতেন, তাহলে আমি তার কথা রাখতে পারতাম। তার ব্যবসায় গিয়ে আমরা বড় হব, সেটা হয় না। কারণ তাহলে আমার চাচাতো ভাইয়েরা আগের নজরে আমাকে দেখবে না।’ তিনি আরো বলেন, ‘চেষ্টায় ত্রুটি না থাকলে সফল হতে কষ্ট হয় না। আমাদের পাড়ায় সবাই পয়সাওয়ালা ছিল। একসময় যেমন বংশাল ও পোস্তায় পয়সাওয়ালা মানুষের বাস ছিল, তেমনি গেন্ডারিয়ায়ও ধনী মানুষ থাকতেন। আমি যখন বিকালে একটু সময় পেতাম, তখন ধূপখোলা মাঠে গিয়ে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়াদের সঙ্গে সময় কাটাতাম। তখন প্রত্যেকের বাড়িতে জায়গিরদার ছিল। তাদের সঙ্গে কথা বলতাম। আমি তো পারিনি, যারা পড়াশোনা করতেন, তাদের কাছ থেকে কিছু জানার চেষ্টা করতাম। এক আনার বাদাম কিনলে ১ ঘণ্টা আড্ডা দেয়া যেত।’ কীভাবে তিনি এ সাফল্যের সাক্ষাৎ পেলেন, এ প্রসঙ্গে তার স্মৃতিচারণ—‘আসলে আমার ব্যবসা খুব ছোট আকারে ছিল। ১৯৮৮ সালে আমার ব্যাংকে ঋণ ছিল ৭-৮ কোটি টাকা। আর নিজেদের কিছু পুঁজি ছিল। ওই বছর বন্যায় সরিষার গুদামে পানি চলে এল। আমার ধারণা ছিল, নিচের কিছু বস্তার সরিষা পচে গেলেও বাকিগুলো ভালো থাকবে। কিন্তু দেখা গেল, ওপরের বস্তাগুলোর সরিষাও পচে গেছে। বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পর পচা সরিষার গন্ধে টেকা দায়। গুদাম পরিষ্কার করতে অনেক কষ্ট হয়েছে।
- ট্যাগ:
- মতামত
- শিল্পোদ্যোক্তা