নির্বাচনী ইশতেহার না প্রহসন?
ইশতেহার হলো বাস্তবতার আলোকে একটি দলের দেশ পরিচালনার দর্শন, যার ভিত্তিতে দলটি ক্ষমতায় গেলে পরবর্তী পাঁচ বছর দেশ পরিচালনার কথা। অর্থাৎ একটি দল নির্বাচনে জয়লাভ করার পর কী করবে তার একটি পরিকল্পনা হলো ইশতেহার। একে নির্বাচনী ঘোষণা বা প্রতিশ্রুতিও বলা হয়ে থাকে। কিন্তু বাংলাদেশে এমনটি হয় কমই। সাধারণত উন্নত দেশগুলোতে নির্বাচনের সময় দলগুলোর ইশতেহারকে যে গুরুত্ব দেওয়া হয়, বাংলাদেশে সেই প্রবণতা নেই বললেই চলে।
মূলত ইশতেহারের বিভিন্ন ইস্যুকে ঘিরে প্রতিদ্বন্দ্বী দলের নেতারা মুখোমুখি হয়ে তর্ক-বিতর্ক করেন, যা দেখে ভোটাররা কাকে ভোট দেবেন সেই সিদ্ধান্ত নিতে সহায়তা পান। এসব আলোচনা ও তর্ক-বিতর্কে বিস্তারিতভাবে উঠে আসে তাদের অর্থনৈতিক পরিকল্পনা, বিভিন্ন নীতিমালার ফলাফল কী হতে পারে, তাদের কোন উদ্যোগ সমাজের কোন স্তরকে কীভাবে প্রভাবিত করবে এমন আরও নানা ইস্যু। কিন্তু বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে এগুলো অনেকটাই বিরল বিষয়।
একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে নির্বাচনের আগে অংশগ্রহণকারী দলগুলো তাদের অঙ্গীকার জনমানুষের সামনে তুলে ধরে। ইশতেহারের প্রধান বিষয় হয় দলগুলোর উন্নয়ন দর্শন। উদ্দেশ্য, জনগণকে তাদের পক্ষে মত প্রদানে আকৃষ্ট করা। এ লক্ষ্যে প্রার্থী বা দল জনমত গঠনের লক্ষ্যে লিখিত বা অলিখিত অঙ্গীকার ব্যক্ত করে। যদিও আমাদের দেশে সরকার গঠনের পর দলগুলোর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে ইশতেহারের অঙ্গীকার প্রতিফলনের প্রবণতা খুব একটা দেখা যায় না। আমাদের দেশে নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা একটা অর্থহীন রেওয়াজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটা করতে হবে বলেই যেন তা করে রাজনৈতিক দলগুলো। দেশের প্রকৃত সমস্যা তেমনভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয় না ইশতেহারে। আবার নির্বাচন হওয়ার পর ইশতেহারের কোনো ফলোআপও হয় না। সাধারণ মানুষ ইশতেহারকে তেমন একটা আমলেও নেয় না। কিন্তু এটা নির্বাচনী সংস্কৃতির বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনেকটা কোটা পূরণের মতো। এর মূল কারণ, আমাদের দেশে জবাবদিহি দাবি করার সংস্কৃতি নেই।
এর পেছনেও একটা নেতিবাচক মনোভাব কাজ করে। আমাদের দেশে বেশিরভাগ রাজনৈতিক দল নির্বাচনী ইশতেহারে অনেক ভালো ভালো কথা বলে। কিন্তু বিজয়ী হওয়ার পর ইশতেহারের সঙ্গে মিল রেখে কাজ করা হয় না। ভোটাররাও তেমন সচেতন নন। তাদের অনেকে নগদ নারায়ণের দিকে অধিক দৃষ্টি দেন। আইনপ্রণেতাদের কাছে তারা স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা, মসজিদ-মন্দিরে অনুদান বাড়ানো, রাস্তাঘাট, ব্রিজ-কালভার্টের দাবি বেশি তোলেন। জাতীয় স্বার্থে আইনপ্রণেতারা কী ধরনের নীতি গ্রহণ করবেন, কেমন ধরনের আইন প্রণয়ন করবেন, তা নিয়ে সাধারণ ভোটাররা খুব একটা মাথা ঘামান না। নির্বাচনে ভোট দেওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে এখনো ইস্যুর ভিত্তিতে দল বিবেচনা করার সংস্কৃতি তৈরি হয়নি। এ কারণে রাজনৈতিক দলগুলোও নির্বাচনী ইশতেহার তৈরিতে খুব একটা মনোযোগ দেয় না। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কথাই ধরা যাক। ভোটের বাকি আছে আর মাত্র দশ দিন। অথচ দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ, যারা দেড় দশক ধরে টানা ক্ষমতায় আছে, তারা এরই মধ্যে ইশতেহার ঘোষণা করেছে। অথচ প্রার্থীদের মনোনয়ন চূড়ান্ত হওয়ার পর আনুষ্ঠানিক প্রচার শুরু হয়ে গেছে প্রায় দশ দিন আগে। তারা নিজ নিজ দল বা জোটের পক্ষে ভোটারদের সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করছেন, কিন্তু নির্বাচিত হলে তারা দলগতভাবে দেশ ও জাতির জন্য কী করবেন, সে সম্পর্কে কোনো ধারণা গতকাল পর্যন্ত দিতে পারেননি।