সুনীল অর্থনীতি উন্নয়নের নবদিগন্ত
বেলজিয়ামে জন্মগ্রহণকারী উদ্যোক্তা, অর্থনীতিবিদ ও লেখক গুন্টার পাওলি ১৯৯৪ সালে প্রথম সুনীল অর্থনীতির ধারণা প্রবর্তন করেন। অর্থনীতির পরিভাষায় সংক্ষেপে এটাকে সামুদ্রিক সম্পদের আহরণ, সংরক্ষণ ও পুনরুৎপাদন প্রক্রিয়াকে বোঝায়। তবে বিশ্বব্যাংক এর একটা সম্প্রসারিত সংজ্ঞা দিয়েছে, যেখানে বলা হয়েছে যে, সামুদ্রিক বাস্তুসংস্থানের স্বাস্থ্য অক্ষুন্ন রেখে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, উন্নত মানের জীবন ও জীবিকা এবং কর্মসংস্থান অর্জনের লক্ষ্যে সামুদ্রিক সম্পদের টেকসই ব্যবহার হলো সুনীল অর্থনীতি। আমাদের দেশে এর অর্থ ও আওতা আরও ব্যাপক; এখানে এর মানে হলো বাস্তুসংস্থানের ভারসাম্য ও জীববৈচিত্র্য অক্ষুন্ন রেখে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ ও উদ্ভাবনের মাধ্যমে সমুদ্রের অনুন্মোচিত সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা, কর্মসংস্থান, দারিদ্র্য বিমোচন, বাণিজ্য ও শিল্পোন্নয়নের লক্ষ্য অর্জন।
বঙ্গোপসাগরের পৃষ্ঠদেশে অবস্থিত বাংলাদেশ অনেক আগে থেকেই নানাভাবে সামুদ্রিক সম্পদ আহরণ করে আসছিল। সেটা ছিল মূলত অপরিকল্পিত ও প্রধানত মৎস্য সম্পদ আহরণের মধ্যে সীমাবদ্ধ। সমুদ্র হলো অপার সম্ভাবনার এক উন্মুক্ত আধার; সেখানে শুধু যে পুঞ্জীভূত মৎস্য সম্পদ থাকে, তাই না, এর তলদেশে যেমন থাকে তেল-গ্যাসের মতো হাইড্রোকার্বনের ভাণ্ডার, তেমনি উপরিভাগে থাকে ঢেউ, স্রোত, বাতাস, জোয়ার ও তাপ থেকে উৎপাদিত নবায়নযোগ্য বিদ্যুতের উৎস। আরও থাকে নানা ধরনের খনিজ পদার্থ, শৈবাল ও জলজ উদ্ভিদ, যেগুলো খাদ্য নিরাপত্তা, মানব স্বাস্থ্য ও পুষ্টির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এজন্য ২০৫০ সালে পৃথিবীতে প্রাক্কলন অনুযায়ী জনসংখ্যা যখন ৯ কোটিতে উন্নীত হবে, তখন খাদ্য ও পুষ্টির চাহিদা পূরণে এই সমুদ্র এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে বলে ধারণা করা হয়।
ভূমি-বুভুক্ষু বাংলাদেশে সুনীল অর্থনীতির গুরুত্ব অপরিসীম। এখানে খাদ্য উৎপাদনের জন্য মানুষ প্রধানত কৃষিজমির ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু পৃথিবীর অষ্টম জনবহুল এই দেশে ভূমি-জন অনুপাত খুবই কম; জনপ্রতি ভূমির লভ্যতা মাত্র ১১.৪৪ শতাংশ (০.০৪৭৮৯ হেক্টর)। জনসংখ্যার ক্রমবর্ধন, নগরায়ণ ও শিল্পায়নের ফলে এখন দ্রুত গতিতে অনেক আবাদি জমি অকৃষি কাজে বেদখল হয়ে পড়ছে। অতি কর্ষণের ফলে ভূমির স্বাস্থ্যও এখন ক্ষয়িষ্ণু। কাজেই আগামীতে বর্ধিত জনসংখ্যার খাদ্য চাহিদা পূরণে দেশের আবাদযোগ্য ভূমির পরিমাণ ও মান পর্যাপ্ত বলে বিবেচিত হবে না। এই প্রেক্ষাপটে সুনীল অর্থনীতির সম্ভাবনা দেশের সামনে এক নবদিগন্তের উন্মোচন।
বাংলাদেশ ২০১২ সালে মিয়ানমার ও ২০১৪ সালে ভারতের সঙ্গে তার বিরাজমান সমুদ্র-সীমানা বিরোধ শান্তিপূর্ণ পন্থায় মিটিয়ে ফেলতে সক্ষম হয় এবং সমুদ্রের মধ্যে ১,১৮,৮১৩ বর্গকিলোমিটার জায়গার ওপর মালিকানা স্বত্ব লাভ করে। এই পরিমাণ জায়গা দেশের মূল ভূখণ্ডের ৮১ ভাগের সমান। তাছাড়াও দেশ দু’শ নটিক্যাল মাইলের একচ্ছত্র অর্থনৈতিক অঞ্চল লাভ করে। এই অর্জন দেশের সমুদ্র ও উপকূলীয় অঞ্চলে মৎস্য আহরণ, মৎস্য চাষ, প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণ ও উন্নয়ন, জাহাজশিল্প, বন্দর ও সমুদ্র পরিবহন শিল্পের উন্নয়ন, পর্যটন শিল্পের উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ, কর্মসংস্থান সৃজন ও প্রবৃদ্ধি অর্জনের ক্ষেত্রে সম্ভাবনার এক নবদ্বার উন্মোচন করে। সমুদ্র বিজয়ের পর দশ বছরেরও বেশি সময় অতিক্রান্ত হয়ে গেছে, কিন্তু এক্ষেত্রে অগ্রগতি আদৌ আশাব্যঞ্জক নয়। যেটা হয়েছে, তা হলো ২০১৩ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেরিটাইম ইউনিভার্সিটি (BSMRMU) প্রতিষ্ঠা, কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে সমুদ্রবিজ্ঞান বিভাগ, ২০১৭ সালে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগে একটা সুনীল অর্থনীতি সেল গঠন, ২০১৮ সালে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব মেরিটাইম রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (BIMRD) প্রতিষ্ঠা ও তার আগে জলসীমা নির্ধারণে ন্যায্যতা পেতে আন্তর্জাতিক আদালতে যাওয়ার প্রাক্কালে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মেরিটাইম অ্যাফেয়ারস ইউনিট নামে একটা বিশেষায়িত সেল গঠন। এগুলোকে আক্ষরিক অর্থে কাগুজে অগ্রগতি বললে অত্যুক্তি হবে না।
- ট্যাগ:
- মতামত
- সমুদ্র সম্পদ
- ব্লু ইকোনমি