সুনীল অর্থনীতিতে ভবিষ্যৎ ও জাপানি বিনিয়োগের সম্ভাবনা
সুনীল অর্থনীতি বা ব্লু-ইকোনমি হলো সমুদ্রের সম্পদনির্ভর অর্থনীতি। সমুদ্রের বিশাল জলরাশি ও তার তলদেশের বিভিন্ন প্রকার সম্পদকে কাজে লাগানোর অর্থনীতি। অর্থাৎ সমুদ্র থেকে আহরণকৃত যেকোনো সম্পদ দেশের অর্থনীতিতে যুক্ত হলে সেটি ব্লু-ইকোনমি বা সুনীল অর্থনীতির পর্যায়ে পড়ে। উন্নত দেশগুলোয় ব্লু-ইকোনমি বা সুনীল অর্থনীতির চর্চা দীর্ঘদিন থেকেই হয়ে আসছে। দেশগুলোর মূল অর্থনীতিতে ব্লু-ইকোনমির ব্যাপক অবদান রয়েছে। সম্প্রতি বাংলাদেশের অর্থনীতিতেও ব্যাপকভাবে সুনীল অর্থনীতির অবদান সংযুক্তির চেষ্টা চলছে। বাংলাদেশের সম্ভাবনা কাজে লাগাতে পারলে বাংলাদেশের অর্থনীতির বর্তমান চেহারা আমূল পাল্টে যাবে।
সমুদ্র হলো পৃথিবীর অন্যতম মূল্যবান প্রাকৃতিক সম্পদের ভাণ্ডার। সমুদ্র মৎস্যসম্পদের মাধ্যমে মানুষের খাদ্য চাহিদা মেটায়। মানুষ ও পণ্য পরিবহনের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার হয়। এছাড়া সমুদ্র বালি, লবণ, কবাল্ট, গ্রাভেল, কপার ইত্যাদি খনিজ সম্পদে ভরপুর। তেল ও গ্যাস আহরণের ক্ষেত্র হিসেবেও সমুদ্র অপরিহার্য। সুনীল অর্থনীতি সম্প্রসারণ হলে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে, দেশের সম্পদ বাড়বে, সামাজিক পুঁজি সৃষ্টি হবে, সর্বোপরি পরিবেশে সঞ্চয়-বিনিয়োগের মধ্যে ভারসাম্য সৃষ্টি হবে।
বর্তমানে বাংলাদেশের মোট সমুদ্রসীমা ১ লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটার, যা মূল ভূখণ্ডের প্রায় সমান। সমুদ্রসীমা জয়ের পর বাংলাদেশে অর্থনৈতিক বিকাশের এক অপার সম্ভাবনা দেখা দিচ্ছে এ খাত থেকে। বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ইলিশের বিপুল চাহিদা রয়েছে। বাংলাদেশে সমুদ্র থেকে আহরিত মাছের মধ্যে ১৬ শতাংশই ইলিশ। এছাড়া বঙ্গোপসাগরে ৪৭৫ প্রজাতির মাছসহ ৩৬ প্রজাতির চিংড়ি রয়েছে। এসব চিংড়ির চাহিদাও প্রচুর। ধারণা করা হচ্ছে, বাংলাদেশের সাগরসীমার মধ্যে তেল ও গ্যাসের খনি রয়েছে। মৎস্য খাত থেকে আয়ের পরিমাণ ২২ শতাংশ, যাতায়াত থেকে ২২ ও গ্যাস-তেল উত্তোলন থেকে আয়ের পরিমাণ ১৯ শতাংশ। প্রায় ১ কোটি ৩০ লাখ বাংলাদেশী মাছ শিকারের সঙ্গে সম্পৃক্ত এবং ৬০ লাখ বাংলাদেশী সমুদ্রের পানি থেকে লবণ তৈরি ও জাহাজ নির্মাণ শিল্পে জড়িত। দেশের প্রায় তিন কোটি মানুষ জীবন ও জীবিকার জন্য সমুদ্রের ওপর নির্ভরশীল। এ বিষয়গুলো বিবেচনায় রেখে বাংলাদেশ সরকার এরই মধ্যে সমুদ্রকে কেন্দ্র করে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য ২৬টি পদক্ষেপ নিয়েছে। এগুলো হলো শিপিং, উপকূলীয় শিপিং, সমুদ্রবন্দর, ফেরির মাধ্যমে যাত্রীসেবা, অভ্যন্তরীণ জলপথে পরিবহন, জাহাজ নির্মাণ, জাহাজ রিসাইক্লিং শিল্প, মৎস্য, সামুদ্রিক জলজ পণ্য, সামুদ্রিক জৈবপ্রযুক্তি, তেল ও গ্যাস, সমুদ্রের লবণ উৎপাদন, মহাসাগরের নবায়নযোগ্য শক্তি, ব্লু-এনার্জি, খনিজ সম্পদ (বালি, নুড়ি ও অন্যান্য), সামুদ্রিক জেনেটিক সম্পদ, উপকূলীয় পর্যটন, বিনোদনমূলক জলজ ক্রীড়া, ইয়টিং ও মেরিনস, ক্রুজ পর্যটন, উপকূলীয় সুরক্ষা, কৃত্রিম দ্বীপ, সবুজ উপকূলীয় বেল্ট বা ডেল্টা পরিকল্পনা, মানবসম্পদ, সামুদ্রিক নিরাপত্তা ও নজরদারি এবং সামুদ্রিক সমষ্টি স্থানিক পরিকল্পনা (এমএসপি)।
বর্তমানে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে সমুদ্রসম্পদের অবদান মাত্র ৯৬০ কোটি ডলার। দেশের স্থলভাগের প্রায় সমপরিমাণ সমুদ্রসীমা মূল্যবান সম্পদে ভরপুর। ভারত ও মিয়ানমার থেকে অর্জিত সমুদ্রসীমায় ২৬টি ব্লক রয়েছে। ইজারা দিয়ে এসব ব্লক থেকে প্রায় ৪০ ট্রিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস পাওয়া সম্ভব মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীনে ২০১৭ সালে ‘ব্লু-ইকোনমি সেল’ গঠন করেছে সরকার।
বাংলাদেশে সমুদ্র অর্থনীতির সম্ভাবনা কাজে লাগাতে এরই মধ্যে পাঁচ ধরনের কৌশল নেয়া হয়েছে। সেগুলো হলো সামুদ্রিক সম্পদের বহুমাত্রিক জরিপ দ্রুত সম্পন্ন করা, উপকূলীয় জাহাজের সংখ্যা বৃদ্ধি ও সমুদ্রবন্দরগুলোর আধুনিকীকরণ এবং সক্ষমতা বৃদ্ধি, অগভীর ও গভীর সমুদ্রে মাছ ধরার কার্যক্রম জোরদারকরণ, সমুদ্রে ইকোট্যুরিজম ও নৌ-বিহার কার্যক্রম চালু করা, সমুদ্র উপকূল ও সমুদ্রবন্দরগুলোকে দূষণমুক্ত রাখা।
- ট্যাগ:
- মতামত
- সমুদ্র সম্পদ
- ব্লু ইকোনমি