দেশের অর্থনীতি মারাত্মক সংকটে নিমজ্জমান
২০২৩ সালের ডিসেম্বর বাংলাদেশের ৫২তম বিজয় দিবসের বার্ষিকীকে ধারণ করছে। ২০২১ সালে আমরা স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন করেছি। তখন প্রায় সব গুরুত্বপূর্ণ সূচক বিশ্বকে জানান দিয়ে চলেছিল যে বাংলাদেশ একটি আত্মনির্ভরশীল ও দ্রুতবর্ধনশীল অর্থনীতিতে পরিণত হতে চলেছে। বিজয় অর্জনের ৫২ বছরে আমাদের প্রশংসনীয় অর্জনগুলো নিয়ে এবারো আনন্দের বন্যায় ভাসার কথা ছিল। কিন্তু বর্তমান সরকারের অর্থমন্ত্রীর অদক্ষতার কারণে অর্থনীতি ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে বিপজ্জনক সংকটে নিমজ্জমান।
দুই বছর ধরে বাংলাদেশের অর্থনীতি যে মারাত্মক সংকটে নিমজ্জমান তার সংক্ষিপ্ত তালিকা দেখুন: বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের বিপজ্জনক পতনের ধারা, টাকার হিসাবে ডলারের অব্যাহত দরবৃদ্ধি, প্রবাসী বাংলাদেশীদের রেমিট্যান্স প্রেরণে গেড়ে বসা হুন্ডি ব্যবসার ক্রমবর্ধমান প্রভাবে ফরমাল চ্যানেলে রেমিট্যান্স প্রবাহে স্থবিরতা, মারাত্মক ডলার সংকটের কারণে আমদানি এলসি খুলতে অপারগতা, কার্ব মার্কেটে হু হু করে ডলারের দাম বেড়ে ২০২১ সালের ৮৭ থেকে ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে ১২৫ টাকায় উল্লম্ফন, বাংলাদেশী টাকার বৈদেশিক মানের প্রায় ২৭ শতাংশ অবচয়ন, আমদানিতে ওভারইনভয়েসিং ও রফতানিতে আন্ডারইনভয়েসিং পদ্ধতিতে দেশ থেকে বিদেশে ব্যাপক পুঁজি পাচার, হুন্ডি পদ্ধতিতে দেশ থেকে বিদেশে ক্রমবর্ধমান ব্যাংক ঋণ পাচার, খেলাপি ব্যাংক ঋণ সমস্যার বিপজ্জনক অবনতি, রফতানি আয় দেশে ফেরত না এনে সেগুলো দিয়ে বিদেশে ঘরবাড়ি-ব্যবসাপাতি ক্রয়, অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিতে বেলাগাম মূল্যস্ফীতির প্রকোপ, দুর্নীতি ও পুঁজি লুণ্ঠন সম্পর্কে সরকারের অব্যাহত নিষ্ক্রিয়তা, দেশের ব্যালান্স অব পেমেন্টসের কারেন্ট অ্যাকাউন্টে চার বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে মারাত্মক ঘাটতি পরিস্থিতি, ব্যালান্স অব পেমেন্টসের ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্টে বহুদিন পর সৃষ্ট বিপজ্জনক ঘাটতি পরিস্থিতি, ২০২২-২৩ অর্থবছরে বৈদেশিক প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ প্রায় বন্ধ হয়ে যাওয়া এবং ২০২৩ সালে রফতানি আয়ের প্রবৃদ্ধি স্তিমিত হওয়ার লক্ষণ। এ সমস্যাগুলোর প্রত্যেকটাই যেকোনো দেশের অর্থমন্ত্রীর ঘুম হারাম করার জন্য বড় সমস্যা হিসেবে বিবেচিত হওয়ার কথা। কিন্তু আমাদের অর্থমন্ত্রীর কাছে এ সমস্যাগুলো সত্ত্বেও দেশের অর্থনৈতিক অবস্থাকে ‘কুসুমাস্তীর্ণ’ মনে হচ্ছে! কারণ দুঃখজনক হলেও সত্য যে দেশের ইতিহাসে অর্থনীতি সম্পর্কে এত স্বল্পজ্ঞানসম্পন্ন কোনো অর্থমন্ত্রী অতীতে কখনই আমরা পাইনি।
বৈদেশিক মুদ্রার গ্রস রিজার্ভ ২০২৩ সালের ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে ১৯ দশমিক ১৩ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছিল, নিট রিজার্ভ নেমে এসেছিল ১৬ বিলিয়ন ডলারের নিচে। ১২ ডিসেম্বর আইএমএফের ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার ঋণের দ্বিতীয় কিস্তির প্রায় ৬৯ কোটি ডলার ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক থেকে ৪০ কোটি ডলার ঋণ পাওয়ায় রিজার্ভ আবার ২০ দশমিক ৪১ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছে। তবে এ সাময়িক বৃদ্ধি টেকসইভাবে ধরে রাখা যাবে কিনা সেটা বলা যাচ্ছে না। বলা বাহুল্য, ২০২১ সালের আগস্টে দেশের রিজার্ভ যেখানে ৪৮ দশমিক শূন্য ৬ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছে গিয়েছিল সেখান থেকে সোয়া দুই বছরে রিজার্ভ ২৮ বিলিয়ন ডলার কমে যাওয়া অর্থনীতিতে বড় ধরনের সংকট ডেকে এনেছে।
বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের দ্রুত পতনের ধারা আমাদের অর্থনীতিকে চরম টালমাটাল অবস্থায় নিয়ে গেছে, তা সামাল দিতে পারছে না সরকার। এরই মধ্যে দেশের আমদানি নিয়ন্ত্রণের নানা ব্যবস্থা গৃহীত হওয়ায় ২০২২ সালের আগস্ট থেকে ১৬ মাসে এলসি খোলা ১৬ শতাংশ কমে এসেছে, কিন্তু হুন্ডি ব্যবস্থায় রেমিট্যান্স প্রেরণকে কোনোমতেই নিরুৎসাহিত করা যাচ্ছে না। হুন্ডি ব্যবসার রমরমা অবস্থা দিন দিন বাড়ার প্রধান কারণ আন্তঃব্যাংক লেনদেনের ক্ষেত্রে বিদ্যমান ডলারের দামের সঙ্গে কার্ব মার্কেটে ডলারের দামের পার্থক্য ৭-৮ টাকায় স্থির থাকা। এ পার্থক্য বজায় থাকলে ডলারের দামে ক্রমবাজারীকরণের সিদ্ধান্ত তেমন সুফল দেবে না, হুন্ডি ব্যবসা চাঙ্গাই থেকে যাবে শক্তিশালী চাহিদার কারণে। ২০২০ সালে নভেল করোনাভাইরাস মহামারী শুরু হওয়ার পর চাহিদা ও সরবরাহ উভয় দিক থেকে হুন্ডি ব্যবসা অনেকখানি গুটিয়ে গিয়েছিল, যার সুফল হিসেবে বাংলাদেশ ২০১৯-২০ ও ২০২০-২১ অর্থবছরে ফরমাল চ্যানেলে রেমিট্যান্সের উল্লেখযোগ্য প্রবৃদ্ধি অর্জনে সমর্থ হয়েছিল। এ প্রবৃদ্ধির কারণেই বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দ্রুত বেড়ে গিয়ে ২০২১ সালের আগস্টে ৪৮ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করেছিল। ২০২১ সালের দ্বিতীয়ার্ধে যখন করোনাভাইরাস মহামারীর তাণ্ডব কমে আসে তখন আবার চাঙ্গা হয়ে ওঠে হুন্ডি ব্যবসা।
২০২২ সালের ১১ সেপ্টেম্বর সরকারের ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্টের (সিআইডি) বরাত দিয়ে দেশের পত্রপত্রিকায় খবর বেরিয়েছে যে শুধু হুন্ডি প্রক্রিয়ায় দেশ থেকে বর্তমানে বছরে ৭৫ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে। এর সঙ্গে আমদানির ওভারইনভয়েসিং, রফতানির আন্ডারইনভয়েসিং এবং রফতানি আয় দেশে ফেরত না আনার মতো মূল সমস্যাগুলো যোগ করলে দেখা যাবে প্রত্যেক বছর এখন কমপক্ষে দেড় লাখ কোটি টাকার সমপরিমাণের বৈদেশিক মুদ্রা থেকে বাংলাদেশ বঞ্চিত হচ্ছে। এর মানে, বাংলাদেশ থেকে বছরে কমপক্ষে ১৫-১৬ বিলিয়ন ডলার পুঁজি এখন বিদেশে পাচার হয়ে চলেছে (অথবা ডলার দেশে আসছে না), যার অর্ধেকের মতো পাচার হচ্ছে হুন্ডি প্রক্রিয়ার বেলাগাম বিস্তারের মাধ্যমে। প্রবাসী বাংলাদেশীদের প্রেরিত রেমিট্যান্স ২০২০-২১ অর্থবছরের ২৪ দশমিক ৭৭ বিলিয়ন ডলার থেকে ২০২২-২৩ অর্থবছরে ২১ দশমিক ৬১ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে, যার প্রধান কারণ হুন্ডি প্রক্রিয়ায় রেমিট্যান্স প্রেরণ আবার চাঙ্গা হওয়া।