মুক্তিযুদ্ধের চেতনাই হোক পথচলার অবলম্বন
১৬ ডিসেম্বর মহান বিজয় দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে ২৬ মার্চ সূচিত মহান মুক্তিযুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটে। ৩০ লাখ শহীদ আর ২ লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে আমাদের দামাল মুক্তিযোদ্ধারা মিত্র বাহিনীর সক্রিয় সহযোগিতায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে পরাজিত করে বিজয় ছিনিয়ে এনেছিল। এই দিনেই ৯৫ হাজার পাকিস্তানি সেনাসদস্য তাদের ইস্টার্ন কমান্ডের প্রধান জেনারেল নিয়াজির নেতৃত্বে রমনা রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) যৌথ বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে। এই রেসকোর্স ময়দানেই ৭ মার্চের ঐতিহাসিক জনসভায় বঙ্গবন্ধু বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করেছিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’।
বলদর্পী পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বাঙালির আশা-আকাঙ্ক্ষাকে পদদলিত করে ২৫ মার্চ গভীর রাতে বাঙালি জনগণের ওপর অত্যাধুনিক মারণাস্ত্র নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে। বঙ্গবন্ধু চূড়ান্ত ধৈর্যের পরীক্ষা দিয়ে ওই রাতেই গ্রেপ্তারের আগে বাংলার স্বাধীনতা ঘোষণা করেন।
দেশবাসীকে যার যা আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করার আহ্বান জানান এবং প্রতিবেশী রাষ্ট্রসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বর্বরতার নিন্দা জানিয়ে বাংলাদেশের পক্ষে দাঁড়ানোর উদাত্ত আহ্বান জানান। বাঙালি জাতি অসম সাহসে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। বাংলাদেশের পক্ষে দাঁড়িয়ে প্রতিবেশী ভারত মুক্তিযুদ্ধ সংগঠনে সব ধরনের সাহায্য-সহযোগিতা করে। সোভিয়েত ইউনিয়নসহ অনেক দেশ বাংলাদেশের মুক্তিকামী মানুষের প্রতি নানাভাবে সাহায্যের হাত প্রসারিত করে। স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার যে ধারাবাহিক রাজনৈতিক যুদ্ধ, তার চূড়ান্ত বিজয় ছিনিয়ে আনতে বাঙালি জাতিকে চরম মূল্য দিতে হয়েছে।
প্রতিবছর বাঙালি জাতির সামনে বিজয় দিবস নতুন জিজ্ঞাসা ও বাস্তবতা নিয়ে হাজির হয়। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর ধীরে ধীরে বাংলাদেশকে পাকিস্তানি ধারায় ফিরিয়ে নেওয়ার প্রবণতা প্রবল হয়ে ওঠে।
১৯৭৫ সালের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর সেনাছাউনিতে ক্ষমতা দখলের লড়াই চলতে থাকল। বেশ কয়েকটি অভ্যুত্থান ও পাল্টা অভ্যুত্থানের পর শেষ পর্যন্ত চরম বিশৃঙ্খলার মধ্যে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলেন। কিন্তু প্রথম দিকে তিনি নিজেকে কিছুটা আড়ালে রাখার চেষ্টা করেছেন। বঙ্গবন্ধুর প্রত্যক্ষ খুনিরা আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক মন্ত্রী খোন্দকার মোশতাক আহমদকে রাষ্ট্রপতির পদে অধিষ্ঠিত করে। মোশতাকের মন্ত্রিসভায় বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভার অধিকাংশ সদস্য যোগ দেন বা অস্ত্রের মুখে যোগ দিতে বাধ্য হন। ১৯৭৫ সালের নভেম্বর মাসের গোড়ার দিকে ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারে আটক অবস্থায় আওয়ামী লীগের চারজন বিশিষ্ট নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, মনসুর আলী এবং কামারুজ্জামান—যাঁরা একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন, তাঁদের নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরাই জেলখানায় এই হত্যাকাণ্ড চালিয়েছিল। ৩ নভেম্বর ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে সংঘটিত আরেক সামরিক অভ্যুত্থানে মোশতাক গদিচ্যুত হন। এরপর বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েমকে রাষ্ট্রপতির আসনে বসানো হয়। স্বল্পকাল ক্ষমতায় থাকাকালীন তিনি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাকে নির্বাচনের মাধ্যমে জনপ্রতিনিধিত্বমূলক সরকারের হাতে হস্তান্তর করে রাষ্ট্রীয় কাঠামোকে আইনগত ভিত্তির ওপর দাঁড় করানোর জন্য চেষ্টা করেন। কিন্তু তাঁর এই প্রচেষ্টা বিফল হয়ে যায় এবং তিনি পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। প্রকৃত ঘটনা হলো, মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান ক্যান্টনমেন্টে তাঁর নিজের অবস্থান সংহত করার পর পর্দার আড়ালে থেকে বেরিয়ে এসে নিজেই আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার জন্য উদ্গ্রীব হয়ে পড়েছিলেন। অবশেষে ক্রমাগত চাপের মুখে বিচারপতি সায়েম তাঁর সামনে পেশকৃত পদত্যাগপত্রে স্বাক্ষর করে তৎক্ষণাৎ বঙ্গভবন ত্যাগ করে নিজের বাসায় চলে যান।
১৯৭৭ সালের ২১ এপ্রিল রাষ্ট্রপতির পদ থেকে বিচারপতি সায়েম পদত্যাগ করার পরপরই জেনারেল জিয়াউর রহমান তাঁর আকাঙ্ক্ষিত রাষ্ট্রপতির পদে আনুষ্ঠানিকভাবে নিজেকে অধিষ্ঠিত করেন। এরপর নজিরবিহীন কায়দায় এক গণভোটের ব্যবস্থা করা হলো। এই ব্যবস্থায় শতকরা ৯৮ ভাগ ভোট জিয়ার পক্ষে পড়েছে বলে দেখানো হয়। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই জিয়া বুঝতে পারলেন যে, বিশ্বজনমত এই ধোঁকাবাজিতে বিশ্বাস করে না, বহির্বিশ্বের জনগণ সামরিক সরকার পছন্দ করেন না। তখন তিনি তাঁর নিযুক্ত উপরাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবদুস সাত্তারের সাহায্য নিয়ে তাঁর সরকারকে বেসামরিক ভিত্তির ওপর দাঁড় করিয়ে সামরিক ক্ষমতাকে আবার পর্দার আড়ালে সরিয়ে রাখলেন। বিচারপতি সাত্তারের সহায়তায় জিয়া ক্যান্টনমেন্টে থেকেই একটি রাজনৈতিক দল গঠন করলেন, যার নাম দিলেন বিএনপি (বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট পার্টি)। অল্প দিনের মধ্যেই কিছুসংখ্যক উচ্চাভিলাষী সাবেক সামরিক অফিসার, ক্ষমতালোভী আমলা, ভাগ্যান্বেষী ব্যবসায়ী এবং খুদে রাজনীতিবিদ বিএনপিতে ভিড় জমালেন। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় অচিরে বিএনপি একটি ‘বড়’ দলে পরিণত হয়। জেনারেল জিয়ার নিজস্ব কোনো রাজনৈতিক দর্শন ছিল না। তিনি দৈবচক্রে মুক্তিযুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু যত দিন বেঁচে ছিলেন, তত দিন তিনি তাঁর একান্ত অনুগত ছিলেন। জিয়া বাকশালে যোগ দিতে দ্বিধা করেননি।