কুইক লিঙ্ক : মুজিব বর্ষ | করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব | প্রিয় স্টোর

পরিকল্পিত বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড

দেশ রূপান্তর সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী প্রকাশিত: ১৪ ডিসেম্বর ২০২৩, ০৯:২৩

বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড কাকতালীয় বা বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা ছিল না। ছিল যেমনি সংলগ্ন, তেমনি পরিকল্পিতও। পরাজয় নিশ্চিত বুঝতে পেরেই বাঙালি জাতিকে মেধাশূন্য করতেই পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর অক্সিলারি ফোর্স আল-বদর বাহিনী নৃশংস এই হত্যাযজ্ঞ সংঘটিত করেছিল। ইংরেজি বিভাগের আমার শিক্ষক জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, একই বিভাগের সহকর্মী রাশিদুল হাসান এবং সব শহীদ বুদ্ধিজীবীর ন্যায় আমারও একই পরিণতি ঘটতে পারত। যদি আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাস ত্যাগ না করতাম। জেনারেল টিক্কা খান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যে ছয়জন শিক্ষককে সতর্কতামূলক চরমপত্র দিয়েছিলেন, ওই ছয়জনের একজন আমিও ছিলাম। আজ যে দুজন শহীদ বুদ্ধিজীবীকে স্মরণ করছি, তারাসহ শহীদ সবাই ছিলেন আমার শিক্ষক, সহকর্মী ও বন্ধু। তাদের কেন আমরা বুদ্ধিজীবী বলি? কেন না তারা সেই সময়ের ব্যবস্থাটাকে মানতে সম্মত ছিলেন না। বরং ভাঙতে চেয়েছিলেন। যেটি পাকিস্তানি শাসকশ্রেণিকে বিচলিত এবং শঙ্কার মুখে ফেলেছিল। পরিণতিতে তাদের হত্যার অভিযান পরিচালিত হয়েছিল, পরিকল্পিত উপায়ে।


জ্যোতির্ময় স্যারের নাম লেখা ছিল মিলিটারি ইনটেলিজেন্সের সেই খাতায়, যেখানে নাম থাকার কথা অত্যন্ত বিপজ্জনক ব্যক্তিদের। এটা তিনি প্রথম টের পেলেন যখন দরখাস্ত করলেন কলকাতা যাওয়ার পাসপোর্টের জন্য। তার বৃদ্ধা মাতা দিন দিন দৃষ্টিশক্তি হারাচ্ছিলেন; সেই মায়ের ইচ্ছা ছিল বড় ছেলেকে দেখবেন। এ জন্য ভেতরে ভেতরে ভারী চঞ্চল ছিলেন জ্যোতির্ময় স্যার। যদিও বাইরে প্রকাশ করতেন না। খুবই প্রকাশবিমুখ ছিলেন তিনি। অনেক চেষ্টা করেছেন, তার হয়ে অন্যরাও চেষ্টা করেছেন। কিন্তু কারোরই সাধ্য ছিল না মিলিটারির খাতায় যার নাম লেখা রয়েছে ‘কমিউনিস্ট’ বলে তাকে পাসপোর্ট দেয়। তিনি প্রভোস্ট ছিলেন জগন্নাথ হলের। সেই হলের ছেলেরা রাষ্ট্রবিরোধী সামরিক প্রস্তুতি নিচ্ছে, এমন একটা বানানো সংবাদে সেনাবাহিনী নাকি খুব ক্ষিপ্ত হয়েছিল এবং শোনা গেছে, প্রভোস্টকে তারা হয়তো গ্রেপ্তার করত ২৫ মার্চের আগেই, যদি-না তুলনামূলকভাবে কিছুটা ভদ্রগোছের একজন লোক থাকতেন প্রাদেশিক গভর্নরের পদে। ২৫ মার্চের রাতেই তাকে গুলি করেছিল হানাদাররা, সময়মতো চিকিৎসা হলে হয়তো তিনি বাঁচতেও পারতেন। কিন্তু মার্চে বাঁচলেও ডিসেম্বরে বাঁচতেন কিনা সন্দেহ, যেমন বাঁচেননি সন্তোষ ভট্টাচার্য, বাঁচেননি জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতারই ছাত্র রাশীদুল হাসান। শহীদ বুদ্ধিজীবী জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা ও রাশীদুল হাসানের মধ্যে বিস্তর ব্যবধান ছিল। বয়সে, অভ্যাসে, রুচিতে যতটা না মিল ছিল, গরমিল ছিল তার চেয়েও বেশি। অন্তত বাহ্যত তো তাই মনে হতো। যদিও তারা দুজনেই ছাত্র ছিলেন ইংরেজি সাহিত্যের, সহকর্মী ছিলেন ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে। কিন্তু তারা কাছাকাছি, খুব কাছাকাছি ছিলেন বিনয়ে; আরও কাছে ছিলেন একে অপরের দেশের প্রতি ভালোবাসায়। সামান্যতার সাধারণ পরিবেশে তারা অসামান্য হয়ে উঠেছিলেন ওই দুই আপাত-সাধারণ, কিন্তু বস্তুত-দুর্লভ গুণে।


রাশীদুল হাসানেরও নাম ছিল মিলিটারির গুপ্ত খাতায়। সেপ্টেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহে তার খোঁজে সশস্ত্র লোকেরা হানা দিয়েছিলেন বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়, হানা দিয়ে ধরে নিয়ে গেল তাকে কলাভবনের কামরা থেকে। তার খোঁজে সশস্ত্র সেনারা আসবে এমন গুরুত্বপূর্ণ নিজেকে তিনি ভাবেননি বলেই প্রস্তুত ছিলেন না, সেনাবাহিনীর লোকেরা এসে অনায়াসে তার খোঁজ পেয়েছিল। পরে ডিসেম্বরে আবার যখন আল-বদররা এলো তখনো বিশ্ববিদ্যালয় এলাকাতেই ছিলেন তিনি। যাওয়ার তেমন জায়গাও ছিল না তার এই শহরে। উদ্বাস্তু হয়ে এসেছিলেন তিনি পশ্চিমবঙ্গ থেকে।


জাত শিক্ষক ছিলেন তারা উভয়েই। জ্যোতির্ময় বাবু শিক্ষক ছিলেন আমার, যেমন তারও কিছু আগে শিক্ষক ছিলেন তিনি রাশীদুল হাসানের। জীবন ও সাহিত্য সম্পর্কে আমার অনেক ধারণাই তার কাছ থেকে পাওয়া। আমি যতটা জানি, তারও চেয়ে বেশি আমার ঋণ। জ্যোতির্ময় স্যার অসংশোধনীয়রূপে যুক্তিবাদী ছিলেন, বিষয়কে তিনি বিশ্লেষণ করে দেখতে চাইতেন তার মূল্য নির্ধারণের পূর্বে। সেই জন্য তার সঙ্গে তর্ক ছিল আমার। আসলে তিনি তর্ক ভালোবাসতেন, মনে-প্রাণে ছিলেন গণতান্ত্রিক। সাম্যবাদী নন, বুর্জোয়া গণতন্ত্রী। সেই জন্য তিনি আহ্বান করতেন বিতর্কে, উৎসাহ দিতেন তর্কে, সর্বোপরি মর্যাদা দিতেন ভিন্নমতের। এমনভাবে দিতেন যতটা কম লোককেই দেখেছি আমি দিতে, আমাদের অগণতান্ত্রিক সমাজে। এ সমাজ আজও অগণতান্ত্রিক, সেকালে আরও বেশি ছিল এর জিজ্ঞাসাহীনতা। তিনি নিজে জানতেন কিনা জানি না, তবে আমরা বিলক্ষণ জানতাম যে, ভেতরে ভেতরে তিনি কোমল ছিলেন, ছিলেন স্পর্শকাতর ও অনুভূতিপ্রবণ। একবার ছুটির সময়ে সেই গেণ্ডারিয়া থেকে নীলক্ষেতে এসেছিলেন আমাদের বাসায় একটা বইয়ের খোঁজে। আমি বাসায় ছিলাম না, ফিরে এসে শুনি অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে গেছেন। না পেয়ে চলে গেছেন শেষ পর্যন্ত। আমার স্ত্রী গিয়েছিলেন রান্নাঘরে, তার জন্য চায়ের ব্যবস্থা করে ফিরে এসে দেখেন স্যার বারান্দাজুড়ে পায়চারি করছেন আর গুনগুনিয়ে গাইছেন গান। ধরা পড়ে স্যার পাছে অপ্রস্তুত হন সেই জন্য আমার স্ত্রী আড়ালে দাঁড়িয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। এই ঘটনা নিয়ে আমরা হেসেছি ঠিকই। কিন্তু অনেক দিন, অনেক সময় আমার স্মৃতির ভেতর তার সেই না শোনা গুনগুনিয়ে গাওয়া গান শুনেছি আমি, আমার চেতনার অজানা স্তরে সেই গান বেজে উঠেছে, আজও ওঠে, যখনই তার কথা মনে করি। তার স্নেহ ওই তার গানের মতোই গুনগুন করে ওঠে। শুধু স্নেহ নয়, জীবন্ত তার উপস্থিতিও।

সম্পূর্ণ আর্টিকেলটি পড়ুন

প্রতিদিন ৩৫০০+ সংবাদ পড়ুন প্রিয়-তে

আরও