বিদেশী নাগরিকত্বে সংসদের ট্রেডিং হাউজে পরিণত হওয়ার ঝুঁকি
আগের বেশকিছু লেখায় উল্লেখ করা হয়েছে, বাংলাদেশে দ্বৈত নাগরিক নামে একটি আইনি সত্তার অনুমোদন ১৯৫১ সালের নাগরিকত্ব আইনের চেতনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। যদিও বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত বিদেশী নাগরিকরা অন্য পাঁচজন বিদেশীদের তুলনায় সীমিত পরিসরে অধিক সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার দাবি রাখেন, তাদের বাংলাদেশী নাগরিকদের (যাদের আনুগত্য শুধু বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতি রয়েছে) সমপর্যায়ে দেখা সমীচীন নয়। বিশেষ করে, দেশের সংবিধানে বর্ণিত যোগ্যতার মানদণ্ড এবং দেশের আইন ও বিধিগুলোর বর্তমান ব্যাখ্যার পরিপ্রেক্ষিতে এটি বোঝা যায় বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত এই বিদেশী নাগরিকরা (এফসিবিও-ফরেন সিটিজেনস অব বাংলাদেশ অরিজিন) দেশের সংসদে সদস্যপদপ্রার্থী হওয়ার জন্য নাগরিকত্ব-সম্পর্কিত পূর্বশর্ত পূরণ করেন না। এমনকি তারা কোনো কোনো সাংবিধানিক পদে অধিষ্ঠিত হতে পারেন না বলে জেনেছি। প্রধানমন্ত্রী সংবিধানকে সমুন্নত রাখার এবং এর মৌলিক নীতিমালার কোনো লঙ্ঘন না হওয়ার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছেন।
ওপরে বর্ণিত প্রেক্ষাপটে, এটা কাঙ্ক্ষিত ছিল রাজনৈতিক দলগুলো, তাদের মনোনীত ব্যক্তিদের প্রার্থী হওয়ার আবেদন নির্বাচন কমিশনে (নিক) জমা দেয়ার আগে, যাচাই-বাছাই করে দেখবেন। সেটা করলে নিকের ওপর চাপ কম পড়ত। তবে অনস্বীকার্য, চূড়ান্ত যাচাই-বাছাইয়ের দায়িত্ব নিক-এর। স্বতন্ত্র প্রার্থীর ক্ষেত্রে এককভাবে তারাই এ কাজটি করবে এবং দলীয় মনোনয়নের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত যাচাই-বাছাইয়ের দায়িত্বও নিক-এর। এ কাজটি পোক্ত হয় যদি নিক প্রার্থী পর্যায়ে এবং মনোনয়নকারী রাজনৈতিক দলগুলো (কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব) কর্তৃক হলফনামা দাখিল বাধ্যতামূলক করা হয়, যেখানে ‘বাইরের দেশের নাগরিক নই’ মর্মে স্বীকৃতি থাকবে। রাজনৈতিক দলগুলোর ক্ষেত্রে অঙ্গীকার থাকবে, মনোনীত কোনো প্রার্থীই বাইরের দেশের নাগরিক নন। এছাড়া বাংলাদেশের বিদেশী মিশন, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর), বাংলাদেশ ব্যাংক (বিবি), দেশের প্রধান গোয়েন্দা সংস্থার কাছ থেকে এবং নেট থেকে সংগৃহীত তথ্য, একজন প্রার্থীর ‘বিদেশী নাগরিকত্বের স্থিতি’ মূল্যায়নে সহায়ক হবে।
সম্প্রতি প্রকাশিত খবরে জানা গেছে, বিদেশী নাগরিকত্ব (সাধারণত দ্বৈত নাগরিকত্ব হিসাবে আখ্যায়িত) থাকার কারণে নির্বাচন কমিশন কারো কারো প্রার্থিতা প্রত্যাখ্যান করেছে। অবহেলিত এ বিষয়টি নিকের নজরে এসেছে এবং তারা এ-সংক্রান্ত কার্যকর উদ্যোগ নিয়েছে জেনে আশা জাগে। সেসব খবরে জানা যায়, বরিশাল-৪ আসনের আ. লীগ মনোনীত প্রার্থী (এবং আ.লীগ আন্তর্জাতিক বিষয়ক কমিটির সচিব!) শাম্মী আহমেদ অস্ট্রেলিয়ান নাগরিক হওয়ার কারণে নিক তার প্রার্থিতার আবেদন প্রত্যাখ্যান করেছে। প্রার্থী আপিল করেছেন কিনা তা অজানা। জানা যায়, এ-সংক্রান্ত সব আপিলের সুরাহা কিছুটা বিলম্বে করা হবে। গণমাধ্যমে আসা আরেকটি দৃষ্টান্ত হলো ফরিদপুর-৩ আসনে আ.লীগের প্রার্থী শামীম হকের প্রার্থিতা বাতিলে স্বতন্ত্র প্রার্থী এ কে আজাদ নিক-কে অনুরোধ করেছেন। জনাব হক বাংলাদেশ ও নেদারল্যান্ডসের দ্বৈত নাগরিকত্বের অধিকারী বলে অভিযোগ করা সত্ত্বেও শামীম হকের প্রার্থিতা আবেদন নাকচ করা হয়নি। জনাব আজাদ আপিল করেছেন বলে জানা গেছে, যদিও সেই আবেদনের ফল জানা যায়নি।
নাগরিকত্ব যাচাই করার জন্য নির্বাচন কমিশনের নিজস্ব কোনো ব্যবস্থা না থাকায় হতাশ হতে হয়। শামীম হকের প্রার্থিতা বাতিলে জনাব আজাদের আপিলের ক্ষেত্রে অনুসরণ করা পদ্ধতিটি পড়লে মনে প্রশ্ন জাগে। কেন একজন প্রার্থী বিদেশী নাগরিকত্ব থাকার কারণে যোগ্য নয়, তা প্রমাণ করার দায়িত্ব অভিযোগকারীর ওপর বর্তাবে? জানা গেছে, আপিলটিতে জনাব হকের বিদেশী পাসপোর্টের ফটোকপি প্রমাণ হিসেবে দিতে হয়েছিল। যদি অন্যান্য সংস্থার সহযোগিতা নিয়ে বিদ্যুতের অর্থ প্রদান, অনাদায়ী ঋণ-সংক্রান্ত ব্যাংক ছাড়পত্র, আয়কর প্রদান, ইত্যাদি পূর্বশর্ত নিশ্চিত নিক-এর পক্ষে করা সম্ভব হয়, সেক্ষেত্রে ভিনদেশের নাগরিকত্ব যাচাই কেন সম্ভব হবে না, তা বোধগম্য নয়। ন্যূনতম প্রতিজন প্রার্থীর একটি হলফনামা জমা দেয়া বাধ্যতামূলক করা উচিত, যেখানে উল্লেখ থাকবে তিনি অন্য কোনো দেশের নাগরিক নন এবং পরবর্তী যেকোনো সময়ে তা মিথ্যা প্রমাণিত হলে, তার প্রার্থিতা বা পদ খারিজ হবে। এ জাতীয় কঠোর ব্যবস্থা না থাকলে জাতীয় সংসদে অনাকাঙ্ক্ষিত এবং সাংবিধানিকভাবে অবৈধ ব্যক্তিদের অনুপ্রবেশ ঘটবে। সেই সম্ভাবনাকে খাটো করে দেখার উপায় নেই। নাগরিকত্বের ব্যাপারে ভুল তথ্য দিয়ে বা তথ্য গোপন করে আরো অনেক প্রার্থী নির্বাচনে অংশগ্রহণে নিকের অনুমোদন পেয়ে থাকতে পারে। সে সবের অনেক ঘটনা সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ না হতে পারে, যার ফলে সেসব প্রার্থীর নাগরিকত্ব, পরিচয় এবং অবৈধ অংশগ্রহণ জনসাধারণের দৃষ্টির অন্তরালে রয়ে যাবে। এটা জরুরি যে নির্বাচন কমিশন বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করবে এবং সংবিধান সমুন্নত রাখার জন্য বর্তমান যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়ায় প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনবে।