রাজনীতির পথপরিক্রমা
মানুষ সামাজিক জীব, সেই সঙ্গে রাজনৈতিকও বটে। সে সক্রিয়ভাবে রাজনীতি করুক, বা না করুক, রাজনীতি তাকে নানাভাবে স্পর্শ করে। প্রাচীন এথেন্সের স্বর্ণযুগের রাষ্ট্রনায়ক পেরিক্লিস যথার্থই বলেছিলেন, “Just because you do not take an interest in politics does not mean politics would not take an interest in you..” রাষ্ট্রের জননিরাপত্তা ও উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত। রাজনীতি এ দুটো কাজকেই নির্ধারণ ও নিয়ন্ত্রণ করে থাকে।
ভারতবর্ষ ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যে স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করেছিল, তার পেছনে স্বরাজের চেয়ে অর্থনৈতিক মুক্তিলাভের আকাক্সক্ষাও কম কিছু ছিল না। এজন্য স্বাধীনতা লাভের পর পরই পরিকল্পিত পদ্ধতিতে নাগরিকদের জীবনমানের উন্নয়নে ভারত ও পাকিস্তান উভয় দেশ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা গ্রহণ করে। পাকিস্তানের বেলায় এই কৌশল আর্থ-সামাজিক স্তরবিন্যাসে আয় ও সম্পদের মালিকানায় ব্যাপক ফারাক সৃষ্টি করে; মাত্র দু’দশকের মধ্যে ২২টি পরিবার দেশের দুই- তৃতীয়াংশ শিল্প এবং তিন চতুর্থাংশ ব্যাংকিং ব্যবসার দখলদারিত্ব নিয়ে নিতে সক্ষম হয়। চিনিয়োটি, মেমন, বোহরা, খোঁজা প্রভৃতি ব্যবসায়ী সম্প্রদায় রাজনীতিতে ক্রমবর্ধমান হারে প্রভাব বিস্তার করতে থাকে।
স্বাধীনতার অর্ধ শতাব্দীর মধ্যে বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে অসামান্য অগ্রগতি অর্জিত হয়। কিন্তু এই সাফল্যের পর এখন দেখা যাচ্ছে- যে বৈষম্যের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে দেশ স্বাধীনতা লাভ করেছে, উন্নয়নের এই পরিক্রমায় আজ দেশ নিজেই যেন সেই বৈষম্যের জাঁতাকলে পিষ্ট হচ্ছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো পরিচালিত ২০২২ সালের খানা আয়-ব্যয় জরিপে দেখা যায়, আয়ের ক্ষেত্রে গিনি সহগের মান এখন হয়ে পড়েছে ০.৪৯৯। এর আগে ২০১৬ ও ২০১০ সালে এই সহগের মান ছিল যথাক্রমে ০.৪৮২ ও ০.৪৫৮। বৈষম্য পরিমাপের জন্য প্রণীত ০ (শূন্য) থেকে ১ পর্যন্ত পরিব্যাপ্ত এই স্কেলে আয় ও সম্পদের মালিকানার ক্ষেত্রে শূন্য হলো পরম সমতা এবং ১ চরম অসমতা নির্দেশ করে। বৈষম্য পরিমাপের জন্য পাল্মা অনুপাতটা আরও সহজবোধ্য; সেখানে সবচেয়ে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর একটা অংশের সঙ্গে সবচেয়ে ধনীদের একটা অংশের আয় ও সম্পদের তুলনা করা হয়। একটা পাল্মা অনুপাতে দেশের সবচেয়ে ধনী ১০ শতাংশের আয়ের সঙ্গে সবচেয়ে গরিব ৪০ শতাংশের আয়ের তুলনা করা হয়েছে। তাতে দেখা গেছে যে, এই অনুপাত ২০১৬ যেখানে ছিল ২.৯, ২০২২ সালে সেটা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩.২। এর অর্থ হলো ২০১৬ সাল থেকে ২০২২ সালের মধ্যে সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ ধনী মানুষের আয় সবচেয়ে গরিব ৪০ শতাংশ মানুষের আয়ের চেয়ে ৩.২ গুণ বেড়ে গেছে। এই ১০ শতাংশ সর্বোচ্চ ধনী মানুষের হাতে এখন দেশের ৪১ শতাংশ আয় কুক্ষিগত, ২০১৬ সালে যেটা ছিল ৩৮ শতাংশ (The Financial Express,November, 2023)। দেখা যাচ্ছে যে, দেশে বৈষম্যের বলগা হরিণ দ্রুতবেগে ধাবমান। প্রদর্শিত গিনি সহগের উল্লিখিত বছরগুলোতে দেশে জিডিপির প্রবৃদ্ধি হয়েছে যথাক্রমে ৭.১০, ৭.১১ ও ৫.৫৭ শতাংশ হারে (macrotrends)। এ চিত্র থেকে অনেকেই অনুমান করতে পারেন যে, উচ্চ প্রবৃদ্ধিই সম্ভবত বৈষম্যকে ক্রমবর্ধমান হারে উসকে দিচ্ছে। তবে এটা শুধু উন্নয়নের মডেলের ত্রুটি নয়, এর পেছনে আরও গুরুত্বপূর্ণ কারণ রয়েছে।
আগে রাজনীতিতে ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের প্রভাবকের ভূমিকা সীমাবদ্ধ ছিল মূলত রাজনীতিতে তহবিল সরবরাহের মধ্যে। কিন্তু এখন তারা রাজনীতির মাঠে প্রত্যক্ষ খেলোয়াড় হয়ে উঠেছেন। পাকিস্তান আমলে ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে জয়ী আইন প্রণেতাদের মধ্যে ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের হার ছিল ৪ শতাংশ। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর, এর ২০ বছর পর এ শ্রেণির অংশীদারত্ব হয় ১৩ শতাংশ। ১৯৭৯ সালে নির্বাচিতদের মধ্যে ব্যবসায়ী ছিলেন ৩৪ শতাংশ, আর ১৯৯৬ সালের সংসদে এই গোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করতেন ৪৮ শতাংশ এমপি (প্রথম আলো ১৩ অক্টবর, ২০১৫)। আর ২০০১ ও ২০০৯ সালে এই সম্প্রদায় থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্যের হার দাঁড়ায় যথাক্রমে ৫২.১০ ও ৬৩ শতাংশ ((The Daily Star, 14 October, 2015)। চলতি সংসদে ব্যবসায়ী এমপির হার ৬১ শতাংশ বলা হলেও অনুমিত হয় যে, আসল হার অনেক বেশি; কারণ, ব্যবসায়ীরা ক্রমবর্ধমান হারে যেমন রাজনীতিতে আসছেন, তেমনি অধিকাংশ রাজনীতিবিদ সংসদে এসে ব্যবসায়ী বনে যাচ্ছেন। বিপরীতে ভারতে লোকসভায় নির্বাচিতদের মধ্যে ব্যবসায়ী মাত্র ২০ শতাংশের মতো। ব্রিটিশ পার্লামেন্টে ব্যবসায়ীদের সংখ্যা কখনো ২৫ শতাংশ অতিক্রম করেনি। মার্কিন কংগ্রেসে তাদের প্রতিনিধিত্ব ৪০ শতাংশের নিচে (প্রথম আলো, ১৩ আগস্ট, ২০১৫)।
- ট্যাগ:
- মতামত
- বাংলাদেশের রাজনীতি