হেনরি কিসিঞ্জারের হাতে বাঙালির রক্ত
শততম জন্মদিন পেরোনোর কয়েক মাস পর মারা গেলেন সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার। যুক্তরাষ্ট্রের ‘খ্যাতিমান কূটনীতিক’ হিসেবে মৃত্যুর পরও অনেকের প্রশংসা পাচ্ছেন তিনি। ফ্যাসিবাদের ভয়াবহতার মুখে কিশোর বয়সে ইহুদি উদ্বাস্তু হিসেবে জার্মানি ছেড়ে পাড়ি জমিয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্রে। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড এম নিক্সনের ‘ডান হাত’ হিসেবে স্নায়ুযুদ্ধের সময়ে মার্কিন কূটনীতির হাল ধরেছিলেন তিনি। আবার চীনের অদম্য উত্থান ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মতো নতুন প্রযুক্তির এই যুগে নানা ক্ষেত্রে ভূমিকা—সবকিছু মিলিয়ে তাঁর শতবর্ষী জীবনকালকে স্মরণ করা হচ্ছে।
জীবনের শেষ দিনগুলোতেও এই খ্যাতি ও প্রাসঙ্গিকতা ধরে রেখেছিলেন কিসিঞ্জার। তিনি ছিলেন ওয়াশিংটনে পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে কাজ করা মানুষদের শিরোমণি। একই সঙ্গে ক্ষমতার পরিবর্তন নিয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করার মতো ক্ষমতা অর্জন করেছিলেন তিনি, যার ফলে পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন ‘ভবিষ্যদ্বক্তা’ হিসেবেও।
কিসিঞ্জারের স্বচ্ছ অন্তর্দৃষ্টি, দূরদর্শিতা ও বুদ্ধিমত্তা দেখে কয়েক প্রজন্মের নীতিনির্ধারকেরা তাঁকে নিয়ে অভিভূত। সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার একবার বলেছিলেন, ‘সর্বোচ্চ পর্যায়ে কূটনীতি যদি একটি শিল্প হয়ে ওঠে, তাহলে হেনরি কিসিঞ্জার ছিলেন কূটনীতির একজন শিল্পী।’
তবে পশ্চিমা বিশ্বের বাইরের বেশির ভাগ মানুষের কাছেই কিসিঞ্জারের এই জীবন প্রশংসনীয় নয়। কম্বোডিয়ায় নির্দয় ও নির্বিচার বোমাবর্ষণের ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ ভূমিকা এবং খেমাররুজের গণহত্যার উদ্দেশ্যে পরিচালিত তাণ্ডবকে পরোক্ষভাবে কিসিঞ্জারের সমর্থন দেওয়ার বিষয়টি নিয়ে ইতিমধ্যে আমার সহকর্মীরা প্রশ্ন তুলেছেন। স্নায়ুযুদ্ধের সময় নিষ্ঠুর ও নির্দয়ের মতো অবস্থান নিয়েছিলেন কিসিঞ্জার। এ কারণে তিনি বিশ্বজুড়ে বহু দেশে নৃশংস হামলা ও সহিংসতা দেখেও চোখ বুজে থেকেছেন। অনেক ক্ষেত্রে এসব সহিংসতা উসকে দিয়েছেন তিনি।
লাতিন আমেরিকার ডানপন্থী জান্তাদের নোংরা যুদ্ধ, আফ্রিকায় শ্বেতাঙ্গ-আধিপত্যবাদী সংখ্যালঘু সরকারকে নিরঙ্কুশ সমর্থন ও ১৯৭৫ সালে পূর্ব তিমুর আক্রমণে ইন্দোনেশিয়ার একনায়ককে সবুজসংকেত দেওয়াসহ বিশ্বজুড়ে এমন অনেক ঘটনায় তৎকালীন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জারের হাত ছিল। পূর্ব তিমুরে ইন্দোনেশিয়ার ওই সামরিক আগ্রাসন ও এর ফলে সৃষ্ট দুর্ভিক্ষে ছোট্ট দ্বীপটির প্রায় দুই লাখ মানুষের প্রাণহানি হয়েছিল।
কিসিঞ্জারকে নিয়ে জানতে চাইলে শান্তিতে নোবেল পুরস্কারজয়ী পূর্ব তিমুরের প্রেসিডেন্ট জোসে রামোস-হোর্তা এ সপ্তাহে আমার এক সহকর্মীকে বলেন, ‘যাঁরা ইতিহাস জানেন, আন্তর্জাতিক রাজনীতি নিয়ে খোঁজখবর রাখেন, তাঁদের (কিসিঞ্জারের) এই অতীত সম্পর্কে জানার কথা, যা দুঃখজনক এবং কুৎসিত।’
তবে কিসিঞ্জারের এই অতীত সম্পর্কে বেশির ভাগ আমেরিকান ওয়াকিবহাল নন, কেউ কেউ জানলেও তা খুব কমই স্মরণ করতে পারেন। এ কথা সত্য, ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ের সময় হেনরি কিসিঞ্জার ও রিচার্ড নিক্সনের ভূমিকা কী ছিল, তা দিয়েই কিসিঞ্জারকে মনে রাখবেন দক্ষিণ এশিয়ার মানুষ।