নতুন আয়কর আইনের প্রবর্তনপর্ব
মন্ত্রিপরিষদে নতুন আয়কর আইন-২০২৩ এর খসড়া নীতিগত অনুমোদন হয়ে এটি যায় জাতীয় সংসদে। নীতিগত অনুমোদনের পর মন্ত্রিপরিষদ থেকে জানানো হয়েছিল, ‘এই আইনের ফলে অনলাইনে আয়কর রিটার্ন প্রদান আরও সহজ হবে। ব্যবসায়ীদের আয়কর নির্ধারণে আগে ২৯টি বিষয়ে মানদন্ড ছিল। তা কমিয়ে ১২টিতে নামিয়ে আনা হয়েছে। মানুষ যাতে ট্যাক্স দিতে উৎসাহিত হয় এবং ট্যাক্সের পরিধি যাতে বাড়ে সেজন্য এই আইনটি করা হয়েছে উল্লেখ করে আরও বলা হয় ,করদাতার করের পরিমাণ আয়কর কর্মকর্তার নির্ধারণ করে দেওয়ার ক্ষমতা থাকছে না এই আইনে। করদাতার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতেই কর নির্ধারিত হবে। ফলে কর্মকর্তার চাপিয়ে দেওয়া করের বিরুদ্ধে আপিলের পরিমাণ কমবে, কমবে করদাতার হয়রানি।’ খসড়া আইনে আরও অনেক অভিনবত্ব ছিল। ৮ জুন গেজেট আকারে বিলটি সংসদে পেশ করা হলে সংসদীয় কমিটিকে ৫ কার্যদিবস সময় দিয়ে ১৫ জুন কণ্ঠভোটে পাস হয়। ২২ জুন মহামান্য রাষ্ট্রপতির অনুমোদনে আয়কর আইন ২০২৩ (২০২৩ সালের ১২ নম্বর আইন) আলোতে আসে। তার ৮ দিন পর ১ জুলাই তারিখে আইনটির প্রয়োগ শুরু হয়।
আইনটিকে আরও করদাতা-বান্ধব করার বিষয়টি সামনে আনার মাধ্যমে আইন প্রণয়নকারীরা রাজনৈতিক অর্থনীতিতে জনপ্রিয়তা বৃদ্ধিতে মন দিয়েছিলেন এটা বোঝা যায়। বহু বছর যাবৎ ঝুলে থাকার পর নির্বাচনী বাজেটবর্ষে সংসদে কণ্ঠভোটে আয়কর আইন পাস এবং উপহার দেওয়ার উপায় উপলক্ষ নির্মাণে যেন সময়সীমা সেভাবেই সাজানো হয়েছে। রাজস্ব আহরণের অন্যতম আইন, প্রত্যক্ষ করের তাৎপর্য ও গুরুত্ব বহনকারী আয়কর আইনটির প্রয়োগ পদ্ধতিটাকে যতটা যুক্তিযুক্ত ও জটিলতামুক্তকরণ সম্ভব, সে দাবি ও প্রত্যাশা থেকে দৃষ্টি সরানোর সুযোগ না থাকা ভালো। লক্ষণীয় হলো আইনটির মুসাবিদা হয়েছে যারা আইনটি বাস্তবে প্রয়োগ করবেন তাদেরই হেঁসেলে। যাদের জন্য এ আইন, যারা এর দ্বারা রাষ্ট্রকে কর প্রদানে প্রণোদিত হবেন, দায়িত্বশীল হবেন তাদের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা কতটা এখানে প্রশমিত হবে সেটা দেখার জন্য তাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা, মতবিনিময়, সুপারিশ পরামর্শ পর্যালোচনার সুযোগকে সীমিত করে বা রেখেই আইনটি জাতীয় সংসদে তড়িঘড়ি করে পাস করানোয় এখন বাস্তবায়নের সময় পদে পদে হোঁচট খেতে হচ্ছে। পুরনো এসআরও দিয়ে পুরনো পদ্ধতি প্রয়োগ করে নতুন আইনের পথ চলা শুরু হয়েছে। ২০১২ সালে মূসক ও সম্পূরক শুল্ক আইন পাসের প্রেক্ষাপট এবং এর প্রয়োগ প্রবর্তনে প্রায় দুই হালি বছরের টানাটানির অভিজ্ঞতা থেকেই প্রসঙ্গটি এসে যায়।
যদিও আইএমএফের ইসিএফ প্রাপ্তির ট্রিগার বা শর্ত পালনের প্রেক্ষাপটে বিদেশের বেস্ট প্র্যাকটিস আমদানি করে প্রণীত মূসক আইনের খসড়া স্টেক হোল্ডারদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করেই সংসদে পাস করা হয়েছিল। সংসদে তখনো প্রায় ৭০ শতাংশ সদস্য ব্যবসায়ী বা মূসকের স্টেকহোল্ডার ছিলেন, তারাই এটি পাস করেছিলেন। মনে রাখতে হবে যে, এর আগে সেই স্টেকহোল্ডাররাই এটি প্রবর্তনে দ্বিমত প্রকাশ করায় বার বার আইনটি প্রবর্তন পিছিয়ে যায়। সুতরাং ‘ভাবিয়া করিও কাজ, করিয়া ভাবিও না’ পরিস্থিতির উদ্ভব আয়কর আইনের ক্ষেত্রে যাতে না হয় সেটি যথা বিবেচনায় আনা বা রাখার দায়িত্ব আমজনতা করদাতাদের পক্ষে তাদের প্রতিনিধি, জাতীয় সংসদের আইন প্রণেতাদের। নির্বাহী বিভাগের মুসাবিদাকৃত আইনটি জাতীয় সংসদে পাস করা আইন হতে হলে ‘জনমত যাচাইয়ের’ সুযোগ কাজে লাগানো বাঞ্ছনীয় ছিল এবং নির্বাহী-নিরপেক্ষ যাচাই বাছাইয়ের অবশ্যই অবকাশ ছিল। এটা উপেক্ষা করে পাস করা আইন অতীতের বহু আইনের মতো অপ্রয়োগযোগ্য কিংবা অপপ্রয়োগের সুযোগ সন্ধানে বার বার সংশোধনের জিকির, ফন্দি ও দাবি উঠতেই থাকবে। মূসক আইনটি জন্মিয়াও জন্মলাভ করিতে পারে নাই, প্রবর্তনের আগেই আইনটি সংশোধনের দাবি উঠেছিল। স্টেকহোল্ডাররা বলেছিলেন আমাদের সঙ্গে পর্যাপ্ত আলোচনা হয়নি, আমাদের সব অভিমত অনুরোধ পরামর্শ গ্রহণ করা হয়নি। এখনো বাজারে গুঞ্জন রয়েছে যে, আয়কর আইনের ওপর আলাপ পরামর্শ সভা ছিল অতি নির্বাহী পরিবেষ্টিত পরিবেশে, সেখানে যে সব স্বাধীন অভিমত সুপারিশ উঠে এসেছিল, সেগুলোর সবটা খসড়ায় প্রতিফলিত হয়েছে কি না, জানার সুযোগ অবারিত ছিল না। মন্ত্রিসভায় অনুমোদিত খসড়া আইনটি সবার দৃষ্টিগোচর করা না হলে, এটি সংসদে অনুমোদনের আগে গণ-অবহিতির ক্ষেত্রে ‘গোপনীয়তা’র নীতি অবলম্বন করা হয়ে থাকলে আইনটির গ্রহণ ও প্রয়োগযোগ্যতা নিয়ে ধূম্রজাল সৃষ্টি হতেই থাকবে।