
প্রতিষ্ঠান এবং স্বদেশ
কখনো কোনো ব্যক্তি বা সমমনা কিছু মানুষ বহুদিন ধরে বা হঠাৎই জনগণের জন্য চিন্তা করল। হোক সে বড় জনগোষ্ঠী বা ক্ষুদ্র—তাদের জন্য কিছু একটা করবে। তারপর জন্ম নিল একটা সংগঠন। সেই সংগঠনের নেতা ঠিক হলো। কর্মীদের দায়িত্ব এসে পড়ল। সঠিকভাবে চলতে চলতে ওই সংগঠনটি একসময় পরিণত হলো একটি প্রতিষ্ঠানে। ওই প্রতিষ্ঠান যদি হয় রাজনৈতিক দল, তাহলে সে কালক্রমে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নিয়ে থাকে। তবে যদি তার মধ্যে কিছু মানুষ আত্মসচেতন হয়ে পড়ে এবং সর্বক্ষণ তার ব্যক্তিগত প্রাপ্তির হিসাব মেলাতে থাকে, তাহলে তা আর জনকল্যাণের কাজটি করতে পারে না। এর মধ্যে একজন স্বৈরাচার হয়ে উঠবে এবং তার সন্তুষ্টি ব্যতিরেকে কোথাও কিছু ঘটবে না।
একদা রাষ্ট্রের মালিকানায় ছিলেন রাজা-বাদশাহরা। বিপুল পরিমাণ সেনাবাহিনী নিয়ে রাজ্য সৃষ্টি করে তার মালিকানায় বসতেন তাঁরা। রাষ্ট্র ছিল যোদ্ধাদের হাতে। একসময় রাজা অনুভব করলেন, নিরস্ত্র প্রজাদের শাসনের জন্য লোক দরকার। পেশির বদলে চাই বুদ্ধি। বুদ্ধির জয় হতে থাকল। বিনা অস্ত্রেও রাজ্য শাসন করা যায়, কিংবা রাজ্যের সম্প্রসারণ করাও সম্ভব। আর এর মধ্যেই বুদ্ধিদীপ্ত কিছু মানুষের সংস্পর্শে এসে রাজা একটু মানবিকও হতে থাকেন, এর মধ্য দিয়ে কিছু কল্যাণ চিন্তা, কিছু সুবিচারের বিধানও ভাবনার মধ্যে আসতে থাকে। এসবের জন্য শিক্ষার বিস্তার ঘটে, সঙ্গে সঙ্গে কিছু প্রতিষ্ঠানও জন্ম নেয়। বীরযোদ্ধা বাবর ভারতবর্ষে এসে অস্ত্র নামিয়ে বুদ্ধিবৃত্তির চর্চাও করতে থাকেন। তাঁর প্রপৌত্র আকবর নবরত্ন সভা করে এত বড় দেশকে শাসন করার একটা সুদূরপ্রসারী ব্যবস্থা নিয়েছিলেন।
শাসনের জন্য কিছু নিয়মকানুনও তৈরি করেছিলেন। সেই নিয়ম অনুযায়ী, জ্যেষ্ঠ ভ্রাতারাই সিংহাসনে বসতেন। নিয়মও মাঝেমধ্যে প্রাচীন হয়ে যায়। আওরঙ্গজেবের সময় আবার পেশিশক্তি প্রবল হয়ে পড়ে। একসময় তা ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধের ভয়াবহ রূপ নেয়। তাই তাঁর মৃত্যুর ৫৭ বছর পর একটি বিদেশি ব্যবসায়িক কোম্পানি ভারতবর্ষকে পদানত করে। আওরঙ্গজেবের পর দেশীয় রাজা-নবাবরা মোটামুটি স্বাধীনভাবেই চলছিলেন। কিন্তু বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার নবাব আলিবর্দী খাঁর উত্তরাধিকারের বিষয়টি স্নেহ বাৎসল্যের বিষয় হয়ে দাঁড়ায়।
কেউ বিষয়টি মেনে নিতে পারেননি। এই সুযোগে ব্যবসায়ী ধূর্ত ইংরেজরা দেশটা কেড়ে নেয়। এখানে এসে আবার প্রমাণ হয় পেশিশক্তিই বড় ব্যাপার নয়। তাই যদি হতো তাহলে নবাব সিরাজউদদৌলা লক্ষাধিক সেনাদল নিয়ে মুষ্টিমেয় ক্লাইভের বাহিনীর সঙ্গে পরাজিত হতেন না। ইংরেজরা পরবর্তীকালে রাজস্ব আদয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান ছাড়া অন্য সব প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করে দেয়। শুধু তা-ই নয়, লুটপাট, প্রতারণা এবং শঠতার আশ্রয় নিয়ে দেশটাকে একধরনের অচলায়তনে পরিণত করে। রাজা শাসিত ইংরেজ জাতি শিক্ষাদীক্ষায় অগ্রসর থাকায়, সে দেশেও কিছু বিবেকবান মানুষের জন্ম হয়েছিল। যাঁরা সে দেশের বিচারব্যবস্থা, শিক্ষা এবং সুশাসনের ভাবনা ভাবতেন।