ভাসানী অস্পষ্ট ছিলেন না
ভাসানী-মুজিব সম্পর্ক নিয়ে সংক্ষেপে একবার দৃকপাত করা যাক; কারণ পাকিস্তান আমলজুড়ে এবং স্বাধীন বাংলাদেশেও এরা দুজনই ছিলেন প্রধান জনব্যক্তিত্ব। উভয়েই ছিলেন সার্বক্ষণিক রাজনীতিক, রাজনীতিই ছিল তাদের মূল জীবন। ভাসানীর লক্ষ্য ছিল জাতীয় মুক্তির সংগ্রামকে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া; এ কাজটা করা মুজিবের পক্ষে সম্ভব ছিল না, কারণ তিনি ছিলেন পুরোপুরি জাতীয়তাবাদী, যদিও সমাজতন্ত্রের আবশ্যকতার কথা তিনি জানতেন, এবং বলতেনও।
মুজিব ছিলেন সোহরাওয়ার্দীপন্থি, যদিও অনিবার্যভাবেই ওই প্রভাব তাকে সেই পরিমাণেই ছিন্ন করতে হয়েছিল যে পরিমাণে তিনি পূর্ববঙ্গকে স্বাধীন করতে চেয়েছেন। স্বাধীন করতে ভাসানীও চেয়েছিলেন। এই পর্যন্ত এই দুই বাঙালি একই পথের যাত্রী। কিন্তু ভাসানী ছিলেন দুর্দান্ত রকমের সাম্রাজ্যবাদবিরোধী, সোহরাওয়ার্দী ছিলেন ঠিক উল্টো পথের পথিক। সাম্রাজ্যবাদকে শেখ মুজিব যে চিনতেন না এমন নয়, কিন্তু তিনিও তার রাজনৈতিক গুরুর মতো এতটা না হলেও অনেকটাই আমেরিকার দিকেই ঝুঁকে পড়েছিলেন। নিজের জাতীয়তাবাদী সংগ্রামে আমেরিকা তার আপন প্রয়োজনেই সমর্থন দেবে বলে মুজিব আশা করেছিলেন এবং শেষ মুহূর্তে যখন জানা গেল যে, তিনি যতদূর যেতে চান আমেরিকানরা ততটা যাওয়া পছন্দ করছে না, তখন তিনি রীতিমতো বিপর্যস্ত বোধ করেন। সাম্রাজ্যবাদ সবকিছুই পারে। যুদ্ধের সময় আমেরিকা পাকিস্তানের পক্ষেই ছিল, এবং যুদ্ধ শেষে মুজিবের ওপর ভরসা করা যাচ্ছে না দেখে তাকে সরিয়ে দেওয়ার কাজে সে যুক্ত হয়েছিল। আইয়ুব শাসনের সময়েও আমেরিকানরা সোহরাওয়ার্দীকে ছেড়ে আইয়ুবকেই সমর্থন করেছে।
মওলানা ভাসানীর সঙ্গে মুজিবের আরও এক জায়গাতে পার্থক্য ছিল। মওলানা নির্বাচনে আস্থা হারিয়ে ফেলেছিলেন ১৯৪৬-এর পরপরই; ওদিকে মুজিব মনে করতেন নির্বাচনের মধ্য দিয়েই ক্ষমতায় যাওয়া যাবে এবং স্বায়ত্তশাসন অর্জিত হবে। নির্বাচনের বিপরীতে মওলানার নির্ভরতা ছিল আন্দোলনের ওপর। কৃষক ও শ্রমিকদের তিনি সংগঠিত করতে চেয়েছেন, ট্যাক্স-খাজনা বন্ধ করে দেওয়ার কথা বলতেন, ঘেরাও ও হাট হরতালের মতো কর্মপন্থা গ্রহণ করে তিনি আন্দোলনকে শহরে তো বটেই, গ্রামেও নিয়ে যেতে চেয়েছেন। মওলানার নির্ভরশীলতা ছিল সাধারণ মানুষ ও মেহনতিদের ওপর, বিদেশিদের কাছ থেকে সহায়তা তিনি আশা করেননি; মুজিব কিন্তু বিদেশিদের সমর্থন-সহায়তা চেয়েছেন। মুজিব আগরতলায় গেছেন, লন্ডনেও গেছেন, ভারতীয়দের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য। ১৯৬৯-এর অভ্যুত্থানের পরে মওলানা একাধিকবার পশ্চিম পাকিস্তানে গেছেন ন্যাপের আহ্বানে এবং কেবল শাসক বদল নয়, পাকিস্তানি রাষ্ট্রব্যবস্থাকেই ভাঙার জন্য মেহনতি মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতে। পশ্চিম পাকিস্তানে মুজিবও গেছেন; গোলটেবিল বৈঠকে যোগ দিতে। গোলটেবিল বসেছিল পাকিস্তানকে ভাঙার জন্য নয়, রক্ষা করার চেষ্টার জন্যই।